প্রশ্ন উধাও হওয়ার জেরে পরীক্ষা পিছিয়ে গিয়েছে। কিন্তু সেটুকুই এ রাজ্যে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা ‘টেট’ ( টিচার্স এলিজিবিলিটি টেস্ট) ঘিরে একমাত্র ‘কেলেঙ্কারি’ নয়, এমনই অভিযোগ বিরোধীদের।
রাত পোহালে কাল, রবিবার ‘টেট’-এ বসবেন প্রায় ২৩ লক্ষ পরীক্ষার্থী। বিরোধীদের দাবি, শাসক দলের নেতা-কর্মীদের একাংশের ‘সৌজন্যে’ তাতে এমন অনেকে বসবেন, প্রশ্নপত্র নিয়ে যাঁদের মাথাব্যথা নেই। কেননা তাঁরা আগাম ‘প্রণামী’ দিয়ে রেখেছেন। টাকার অঙ্কটা কোথাও আট লাখ, কোথাও দশ-বারো। চাকরিপ্রার্থীদের কেউ পেয়েছেন ‘গ্যারান্টি’। আবার কারও ভরসা আশ্বাসে, ‘চাকরি যদি না-ও হয়, অন্য ভাবে পুষিয়ে দেওয়া হবে’। বিরোধীদের হিসেবে, বীরভূম থেকে মেদিনীপুর থেকে বর্ধমান থেকে দক্ষিণ দিনাজপুর— প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির মানচিত্রে বাদ নেই রাজ্যের প্রায় কোনও জায়গাই।
সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র টিপ্পনী, ‘‘টেট পরীক্ষায় না কি এক-একটা চাকরির বাজারদর দশ লক্ষ টাকা পর্যন্ত উঠে গিয়েছে। মানে যে টাকা দেবে, চাকরি তার।’’ অভিযোগ মানেননি তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব। তাঁদের বক্তব্য, ‘‘দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সব সময়েই স্বচ্ছতার পক্ষে। তেমন কিছু হয়ে থাকলে নিশ্চয়ই লিখিত অভিযোগ হবে। এ পর্যন্ত তেমন অভিযোগ হল কোথায়?’’ শিক্ষামন্ত্রী তথা তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘পরীক্ষার্থীদের বলছি, অযথা অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হবেন না।’’
প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ সূত্রের খবর, ‘ফেলো কড়ি, পাও টেট’ গোছের অভিযোগ তাদের দফতরেও এসেছে। তবে দফতরের এক কর্তা জানান, সে সব অভিযোগে শাসক দলের বিরুদ্ধে আঙুল উঠেছে বলে তাঁদের জানা নেই। পর্ষদ সভাপতি মানিক ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘বারবার বিজ্ঞাপন দিয়ে পরীক্ষার্থীদের সতর্ক করেছি। বলেছি, কোনও চক্রের প্রলোভনে পা দেবেন না। এমন কোনও চক্রের হদিস পেলে অবশ্যই পুলিশ-প্রশাসনকে জানান।’’ শিক্ষামন্ত্রীও বলেন, ‘‘পরীক্ষার্থীরা রবিবার হাতে সময় নিয়ে পরীক্ষাকেন্দ্রে এসে মন দিয়ে পরীক্ষা দিন। নিজেদের মেধায় ভরসা রাখুন। অর্থের বিনিময়ে মেধা কিনে নেওয়ার কোনও দুষ্ট-চক্রের সন্ধান পেলে অভিযোগ জানান।’’
বিরোধীরা অবশ্য মনে করিয়ে দিচ্ছেন শাসক দলের গোষ্ঠী-কোন্দলেই টেট-দুর্নীতি প্রকাশ্যে এসেছে দক্ষিণ দিনাজপুরে। কুমারগঞ্জে প্রকাশ্য সভাতেই দলের বিধায়ক মাহমুদা বেগমের বিরুদ্ধে দালাল মারফত ১২ লক্ষ টাকা করে তোলার অভিযোগ এনেছেন জেলা তৃণমূলের সহ-সভাপতি অজিত সরকার-সহ কিছু নেতা। তাঁদের দাবি, গত বারও একই ভাবে ২৬ জনকে চাকরি ‘বিক্রি’ করা হয়েছিল। অভিযোগ উড়িয়ে বিধায়ক বলেন, ‘‘গত বার অজিতবাবুর মেয়ের চাকরি কী ভাবে হয়েছিল, তা তো বলছেন না! আমি সুপারিশ না করলে হতো?’’
সেই সূত্রেই সিপিএম সাংসদ ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য, ‘‘মধ্যপ্রদেশের ব্যপম কেলেঙ্কারিকে ছাপিয়ে যাবে এ রাজ্যের টেট কেলেঙ্কারি! আমাদের কাছে বিভিন্ন জেলা থেকে অভিযোগ এসেছে, টেটে চাকরি পাওয়ার আশ্বাসে টাকা জোগাড়ের জন্য অনেককে জমিজমা বা অন্য সম্পত্তি বেচতে হয়েছে।’’ সিভিক ভলান্টিয়ার, গ্রিন পুলিশ বা হোমগার্ড নিয়োগেও একই রকম ‘দুর্নীতির খেলা’ হয়েছে বলে অভিযোগ কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়ার। বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের হুঁশিয়ারি, বড় কোনও তথ্য-প্রমাণ জোগা়ড় করতে পারলে আদালতের দ্বারস্থ হবেন তাঁরা।
তবে হাতেগরম তথ্যপ্রমাণ কতটা মিলবে, তা নিয়ে সন্দেহও রয়েছে বিরোধীদের একাংশের। গত বারই বর্ধমানের কালনায় টেট-দুর্নীতি নিয়ে তৃণমূলের এক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পোস্টার সেঁটেছিল, মিছিল করেছিল অন্য গোষ্ঠী। সিপিএমের রাজ্য কমিটির সদস্য অমল হালদারের অভিযোগ, ‘‘সেই সুবাদে এ বার চুপিসাড়ে তৃণমূলের প্যানেল তৈরি করা হয়েছে। সাধারণেরা চাকরি পাবেন কি না, কে জানে।’’ অভিযোগ মানেননি জেলা তৃণমূলের (গ্রামীণ) সভাপতি স্বপন দেবনাথ। বলেছেন, ‘‘সবটাই অপপ্রচার।’’ তবে কালনা ২ ব্লকে খোঁজ মিলেছে এক কৃষিজীবী পরিবারের, যার কর্তার দাবি, ‘‘মাসকয়েক আগে এলাকার এক তৃণমূল কর্মীকে আট লাখ টাকা দিয়েছি। শুনেছি, সে টাকা উপর পর্যন্ত যাবে। মেয়ে টেট-এ পাবেই।’’
বিরোধীদের অভিযোগ, মুর্শিদাবাদে তৃণমূলের ব্লক স্তরের নেতারা তিন-পাঁচ লাখ, জেলা নেতারা দশ লাখ পর্যন্ত ‘দর’ হাঁকছেন। নদিয়ার কল্যাণী, চাকদহ, রানাঘাট ও হরিণঘাটায় ৪ লাখ থেকে দরাদরি শুরু হয়েছে। পশ্চিম মেদিনীপুরে গত বার ‘দর’ ছিল ৪ থেকে ৮ লাখ পর্যন্ত। এ বার ৬ লাখ থেকে শুরু হয়েছে। পূর্ব মেদিনীপুরেও প্রার্থীপিছু ১০-১২ লাখ চাওয়া হচ্ছে বলে বাজারে খবর।
এসএফআইয়ের রাজ্য সভানেত্রী মধুজা সেন রায়ের কথায়, ‘‘টেট নিয়ে রীতিমতো মাছ-বাজারের মতো দর কষাকষি চলছে।’’ ছাত্র পরিষদের সহ-সভাপতি মহম্মদ সাইফুলের কটাক্ষ, ‘‘টেট এখন ‘তৃণমূল এলিজিবিলিটি টেস্ট’। সেখানে মানদণ্ড হল টাকা এবং তৃণমূল-যোগ।’’ আবার অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের রাজ্য সম্পাদক সুবীর হালদার ধরিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘এখন লগ্নি সংস্থার সেন-কুণ্ডুরা নেই, যাঁদের টাকায় বিধানসভা ভোট করানো হবে। সেই ক্ষতি মেটাতে টেট এখন সহায়।’’
বিরোধীদের দাবি, টাকা তোলা হচ্ছে সাধারণত তিন ধাপে। পঞ্চায়েত স্তরে ‘কনট্যাক্ট পার্সন’ ( নেতার স্থানীয় প্রতিনিধি) একের চার ভাগ নিচ্ছেন, ‘টেট-চক্রে জড়িত’ ব্লক স্তরের নেতা নিচ্ছেন এক-চতুর্থাংশ, বাকি অর্ধেক যাচ্ছে জেলা স্তরে। সরাসরি জেলা নেতার দ্বারস্থ হলে টাকা কম লাগছে।
বিএড প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং প্রশিক্ষণবিহীনদের ‘প্রণামী’ আবার আলাদা। এমন ‘অভিজ্ঞতা’ বীরভূমের সিউড়ির এক চাকরিপ্রার্থীর। যুবকের দাবি, বিশেষ সূত্রে খবর পেয়ে নলহাটি ২ ব্লকের কৃষ্ণপুর বিএড কলেজের কাছে শাসক দলের এক প্রভাবশালী নেতার বাড়িতে যান। নেতা দেখা করেননি। ‘ইন্টারভিউ’ নেন নেতার-অনুগামীরা। প্রশ্ন করে, ‘কোথা থেকে এসেছেন, কে পাঠিয়েছে?’ যুবকের জবানিতে, ‘‘এক চেনা নেতার নাম করতেই পরের প্রশ্ন, ‘প্রশিক্ষণ আছে না নেই?’ প্রশিক্ষণ থাকলে ৫ লাখ, না হলে ৮-১০ লাখ!’’ যুবকটি এগোননি।
সিপিএমের রাজ্য স্তরের এক নেতার টিপ্পনী, ‘‘খোঁজ নিয়ে দেখুন, তৃণমূল কর্মী হলেও ছাড় নেই। যে দাদা টাকা নিচ্ছেন, দলে তাঁর ভিন্ন গোষ্ঠীর লোককে হয়তো সাধারণের চেয়ে বেশি টাকা দিতে হবে।’’ ময়ূরেশ্বরে ঢেকা পঞ্চায়েত এলাকায় দলের মিছিলে-সভায় পরিচিত মুখ এমনই এক তৃণমূলের কর্মীর আক্ষেপ, ‘‘এক জেলা নেতার কাছে গিয়েছিলাম। তিনি বললেন, মুখের কথায় তো চাকরি হবে না। আট লাখ টাকা নিয়ে আয়। দিতে না পারলে, ১০০ দিনের কাজে সুপারভাইজারি কর’।’’ আবার নানুরের ব্লক স্তরের এক তৃণমূল নেতার দাবি, দলে গোষ্ঠী বদল করেছেন স্রেফ ছেলের চাকরির জন্য। তাঁর কথায়, ‘‘টাকা যাঁরা নিচ্ছেন, তাঁদের পান্ডার বিরোধী গোষ্ঠীতে ছিলাম বলে কাজ হচ্ছিল না। শিবির বদলানোয় এ বার ছেলের নাম নেওয়া হবে বলে মনে হচ্ছে। পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত দেব বলেছি।’’
কী পদ্ধতিতে চাকরি পাওয়ানোর ব্যবস্থা হচ্ছে? ‘প্রণামী’ দেওয়া চাকরিপ্রার্থী, বিরোধীদের দাবি (তৃণমূল অন্দরেরও একই খবর), পরীক্ষার্থীদের ফাঁকা খাতা জমা দিয়ে আসতে বলা হয়েছে। সেটাই প্রাথমিক সঙ্কেত যে টাকা দেওয়া হয়েছে।, ভবিষ্যতে যদি খাতা চ্যালেঞ্জ বা মামলাও হয়, সে ক্ষেত্রে ফাঁকা খাতায় ঠিক উত্তর লিখে প্রকাশ্যে আনা যাবে। তবে চাকরিপ্রার্থীদের মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে, সন্দেহ এড়াতে যদি বা কিছু লিখতেও হয়, তা পেনসিলে লিখতে, যাতে পরে মুছে দেওয়ার সুযোগ থাকে।
কোন বিশ্বাসে নেতাদের এত টাকা দিচ্ছেন চাকরিপ্রার্থীরা? যাঁরা ইতিমধ্যে টাকা দিয়েছেন তাঁদের বেশির ভাগেরই বক্তব্য, গত বারের ফল দেখেই ‘সার সত্য’ বুঝে গিয়েছেন। গত বছর মেদিনীপুরে এক যুব নেতা ও তাঁর স্ত্রী ‘টেট’-এ বসে চাকরি পান, চাকরি হয়েছে এক কর্মাধ্যক্ষের ছ’জন আত্মীয়ের। বীরভূমের ময়ূরেশ্বর ২ ব্লকে তৃণমূলের এক জেলা নেতার মেয়ে, লাভপুরের এক ব্লক নেতার ভ্রাতৃবধূ ও ভাইপো চাকরি পেয়েছেন। অথচ, ওই দুই জেলাতেই অনেক কৃতী পড়ুয়া সুবিধা করতে পারেননি।
তৃণমূল-শিবিরের যুক্তি, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় আপাত সাধারণেরাও মেধাবীদের পিছনে ফেলতেই পারেন। কিন্তু চাকরিপ্রার্থী এবং বিরোধীরা প্রায় এক সুরে বলছেন, ‘‘তা হলে বলতে হবে এত বেশি সংখ্যায় শাসক দলের নেতাদের কাছের লোকজনের চাকরি পাওয়াটা একেবারেই কাকতালীয়।’’
গত বার টাকা দিয়ে চাকরি পাননি, এমন তিক্ত অভিজ্ঞতাও রয়েছে অনেকের। এ বারেও চাকরির নিশ্চয়তা কোথায়? নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বীরভূমের একাধিক অভিভাবকের দাবি, তৃণমূলের জেলা স্তরের এক নেতার কাছে সে প্রশ্ন করে জবাব মিলেছে, ‘‘চাকরি না পেলে কিছু বাড়ি দেখিয়ে দেব। সে সব বাড়িতে চুরি-ডাকাতি করতে পারেন। জামিনে ছাড়ানোর দায়িত্ব আমার।’’
‘‘কে বলছে এমন কথা’’, প্রশ্ন তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের। পরে অনুব্রত বলেন, ‘‘টাকা লেনদেনের অভিযোগ একেবারে ভিত্তিহীন। যোগ্যতার নিরিখেই প্রার্থীরা চাকরি পাবেন। কেউ টাকা চাইলে সরাসরি পুলিশের কাছে অভিযোগ করুন।’’ আরও এগিয়ে তৃণমূলের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সভাপতি দীনেন রায় এবং মুর্শিদাবাদ জেলা সভাপতি মান্নান হোসেনের দাবি, ‘‘এ সব বাম-আমলে হতো। পায়ের তলা থেকে জমি সরে যাওয়ায় বিরোধীরা তৃণমূলের বিরুদ্ধে এমন অপপ্রচার চালাচ্ছেন।’’