বর্জ্য সংগ্রহের কাজ গঙ্গাসাগরে। নিজস্ব চিত্র
অতিমারির আতঙ্ক হোক বা কড়া বিধিনিষেধের প্রভাব, গঙ্গাসাগরে ভিড় এ বার তুলনায় কম ছিল বলে জেলা প্রশাসনের পর্যবেক্ষণ। কিন্তু মেলার পরে দেখা যাচ্ছে, প্লাস্টিক বর্জ্যের পাহাড়ের উচ্চতা বাড়তির দিকেই। সব ধরনের বর্জ্যের হিসেবেও আগের বছরকে টেক্কা দিতে চলেছে সদ্য-সমাপ্ত সাগরমেলা। এ বারের মেলার জেরে কোভিড সংক্রমণের মাত্রা কোথায় পৌঁছবে, সেটা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে বিপজ্জনক প্লাস্টিক-দুশমন সমানে চোখ রাঙাচ্ছে পরিবেশকে। আশার কথা এটাই যে, এই অবস্থায় পুনর্ব্যবহারের অযোগ্য প্লাস্টিক প্রক্রিয়াকরণে নতুন একটি প্রকল্প হাতে নিচ্ছে রাজ্য সরকার। সেই বেয়াড়া প্লাস্টিকের সদ্গতির ব্যবস্থা হচ্ছে রউরকেলার সিমেন্ট কারখানায়।
জেলা প্রশাসনের হিসেব অনুযায়ী গত বছর ৮-১৭ জানুয়ারির মধ্যে গঙ্গাসাগরে বর্জ্যের পরিমাণ ছিল ১৬৭ মেট্রিক টন। তার মধ্যে ৪৫ মেট্রিক টনই ছিল ‘নন বায়োডিগ্রেডেবল’ বা অপচনশীল বর্জ্য (যার প্রায় ৯০ শতাংশই প্লাস্টিক)। এ বছর বর্জ্যের গাণিতিক পরিমাণ এখনও সম্পূর্ণ নির্ধারিত হয়নি। তবে প্রাথমিক ভাবে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত যে-হিসেব মিলছে, তাতে প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণের দিক থেকে ২০২১-এর সাগরমেলাকে ইতিমধ্যেই টেক্কা দিতে চলেছে এ বারের মেলা। দেখা যাচ্ছে, ১৫ জানুয়ারির মধ্যেই ১৬৯.১৭২ মেট্রিক টন বর্জ্য জমেছে এবং তার মধ্যে প্লাস্টিক-সহ অপচনশীল বর্জ্য ৪১.৪৪৫ মেট্রিক টন। এই হিসেব নামখানা, লট নম্বর ৮, কচুবেড়িয়া, চেমাগুড়ি, সাগরমেলার ১, ৫ এবং ৫এ ইউনিট এলাকার। মেলার সঙ্গে যুক্ত সরকারি কর্তা তথা বর্জ্য নিয়ন্ত্রণ বিশারদদের অনুমান, আরও দু’দিনে প্লাস্টিকের মতো বর্জ্যের পরিমাণেও ২০২১-কে ছাপিয়ে যাবে ২০২২-এর সাগরমেলা। সব মিলিয়ে মোট বর্জ্যের পরিমাণ ২০০ মেট্রিক টন ছুঁতে পারে।
জলবায়ু নিয়ে কেন্দ্রীয় প্রকল্পের (ন্যাশনাল অ্যাকশন প্ল্যান ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ) সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, সমুদ্রতীরে পড়ে থাকা বর্জ্যের ৮০ শতাংশই পরিবেশের সঙ্গে জৈব ভাবে মেশার অযোগ্য প্লাস্টিক, থার্মোকল গোছের বিপজ্জনক বস্তু।
জেলা প্রশাসনের পরিচালনায় দক্ষিণ ২৪ পরগনায় বর্জ্য নিয়ন্ত্রণের প্রকল্পে যুক্ত একটি সংস্থার আধিকারিক প্রসূনকান্তি দাস বলছেন, “পড়ে থাকা প্লাস্টিকের খানিকটা কাবাড়িওয়ালা বা জঞ্জালকুড়ানিরা নিয়ে যান। কিন্তু সাগরমেলায় ব্যবহৃত প্লাস্টিকের অনেকটাই ‘রিসাইকল’ বা পুনর্ব্যবহারের অনুপযুক্ত। সেগুলো পোড়ালেও পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর গ্যাস বেরোয়। এ বছর তাই এই সমস্যার মোকাবিলায় আমরা রিসাইকল বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নিচ্ছি।” প্লাস্টিকের মোকাবিলায় প্রশাসনিক আধিকারিকেরা এ বার উত্তরপ্রদেশে কুম্ভমেলায় এই কাজের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একটি সংস্থার সাহায্য নিচ্ছেন। আজ, সোমবার তাঁরা এ কাজে হাত দেবেন। এই উদ্যোগে যুক্ত বর্জ্য প্লাস্টিক নিয়ন্ত্রণ বিশারদ সঙ্ঘমিত্রা মুখোপাধায় বলেন, “সাগরের প্লাস্টিকের মধ্যে কোনটা পুনর্ব্যবহারের অযোগ্য, তা খতিয়ে দেখে আমরা রউরকেলার সিমেন্ট কারখানায় পাঠাব। সেখানে কয়লার সহযোগী হিসেবে কোপ্রসেসিংয়ের কাজে প্লাস্টিক ব্যবহার করা হবে।”
সাগরমেলায় প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানোর নানা চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু মেলার সঙ্গে যুক্ত আধিকারিকদের অভিজ্ঞতা, মেলার রোজনামচায় বিপজ্জনক প্লাস্টিক এখন ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে। সঙ্ঘমিত্রাদেবীর কথায়, “ধূপের প্যাকেটের ভিতরের মোড়ক, জলের বোতলের লেবেল, চিপস, বিস্কুট, গুটখার প্যাকেট থেকে শুরু করে সাগরস্নানের সময় ব্যবহৃত শ্যাম্পুর পাউচ পরিবেশের পক্ষে বিষবৎ। তার বেশির ভাগই মাল্টিলেয়ারড প্লাস্টিক এবং তাদের ঘনত্ব ৫০ মাইক্রনেরও কম। এগুলো সংগ্রহ করে উপযুক্ত সুরক্ষা বিধি-সহ কারখানায় ব্যবহার করাটাই সদ্গতির উপায়।” ইতিমধ্যে নৈহাটি, শ্রীরামপুর, টিটাগড়ের মতো কয়েকটি পুরসভা এলাকায় এই ভাবেই বিপজ্জনক প্লাস্টিক নিয়ন্ত্রণের কাজ চলছে।
গঙ্গাসাগর বকখালি উন্নয়ন পর্ষদের কার্যনির্বাহী আধিকারিক শম্ভুদীপ সরকার বলেন, “বর্জ্য সংগ্রহের কাজটা আরও ভাল ভাবে হয়েছে বলেই তার পরিমাণ বেড়েছে, বাড়ছে। সারা বছরই সাগরদ্বীপে এই কাজ চলায় বাড়ছে সচেতনতা। নানান উদ্যোগে বর্জ্যের সদ্গতির ব্যবস্থাও আগের থেকে অনেক ভাল হয়েছে।”