গান গাইছেন রাণু মারিয়া মণ্ডল। ছবি: প্রণব দেবনাথ
ট্রেনের বাঁশি। চারপাশ দিয়ে চলে যাওয়া নিত্যযাত্রীর ভিড়। কর্মব্যস্ততা। হকারের চিৎকার। পাশে বসে থাকা শিশুর পাতা হাত।
তারই মধ্যে গুনগুন করছে সুরেলা গলা—‘‘কুছ পা কর খোনা হ্যায়, কুছ খো কর পানা হ্যায়...।’’
গত কয়েক দিন ধরে ভাইরাল হয়েছে এই গানের ভিডিয়ো। ‘শোর’ ছবিতে মুকেশ-লতার গলায় সুপারহিট এই গানের দৌলতেই প্রায় রাতারাতি ‘সেলিব্রিটি’ বনে গিয়েছেন রানাঘাটের হতদরিদ্র রাণু মারিয়া মণ্ডল।
রানাঘাট স্টেশনে বসে অনেক দিন ধরেই গুনগুন করেন রাণু। কেউ কোনও বিশেষ গান শোনানোর অনুরোধ করলে তা-ও গেয়ে শোনান। শুনতে শুনতেই স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে তাঁর গান রেকর্ড করেছিলেন এক যাত্রী। পরে ফেসবুকে তিনি তা তুলে দিতেই রীতিমতো হিট।
এমন গানের গলা নিয়ে কী ভাবে রাণু পৌঁছে গেলেন নদিয়ার রানাঘাট স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে? রাণুর এখন আর সবটা স্পষ্ট মনে পড়ে না। কিছু ছেঁড়া ছেঁড়া ছবি। রাণু জানান, তাঁর বাড়ি ছিল কৃষ্ণনগরের নতুনপাড়ায়। পরে তিনি রানাঘাটের বেগোপাড়ায় মাসির বাড়িতে চলে আসেন। বিয়ে হয়। স্বামীর সঙ্গে চলে যান মুম্বই। আঠারো বছরের সংসার। সেখানেই রয়েছে দুই ছেলেমেয়ে। ইতিমধ্যে মানসিক অবসাদে ভুগতে থাকায় তিনি ফিরে আসেন বেগোপাড়াতেই।
৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক থেকে খানিকটা গেলে একটা চাষের জমি। তার পাশেই দু’টি ইটের ঘর আর একফালি বারান্দা নিয়ে এক তলা বাড়ি। পাশের বাঁশঝাড় থেকে পাতা উড়ে বিছিয়ে রয়েছে উঠোনে। এই বাড়িতেই বছর বারো ধরে রয়েছেন রাণু। মাসি থাকেন কলকাতায়।
শুক্রবার দুপুরে সেই ঘরের সামনে বসে রাণু বলেন, “কেউ লেখাপড়া শেখায়নি আমায়, গানও শেখায়নি। কেউই তো কিছু করেনি। নিজের চেষ্টায় রেডিয়ো আর টেপ রেকর্ডার থেকে গান শিখেছি। পরে একটা অর্কেস্ট্রা দলের সঙ্গে অনুষ্ঠান করেছি।’’
একা একা ঘরে তাঁর মন টেকে না। হাঁটতে হাঁটতে চলে যান কিলোমিটার দেড়েক দূরে রানাঘাট স্টেশনে। ভিড়ে ঠাসা প্ল্যাটফর্মে তাঁর সঙ্গী শুধু গান। লোকে মায়া করে দু’চার টাকা দিয়ে যায়, কেউ কখনও কিনে দেয় খাবার, তাতেই ওঁর চলে যায়।
অন্তত যাচ্ছিল এত দিন।
এখন কেউ রাণুর তুলনা করছেন লতার সঙ্গে। কেউ আবার টানছেন ভিডিয়ো-তারকা ‘ঢিনচ্যাক পূজা’র তুলনা। শুক্রবার সন্ধেতেই রানাঘাট ২-এর বিডিও খোকন বর্মণ এক মহিলা অফিসারকে পাঠিয়েছেন তাঁর বাড়ি। বিডিও বলেন, ‘‘সোমবার ওঁকে এসে দেখা করতে বলেছি। দেখা যাক, ওঁর মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই করে দেওয়া যায় কি না।’’
লাজুক হেসে রাণু শুধু বলছেন, ‘‘সবাই বলে, আমি ভাল গান গাই। সবাই খুশি হলে আমিও খুশি।’’