বামেদের বিক্ষোভ মিছিল। বৃহস্পতিবার মৌলালি এলাকায়। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।
ধর্মঘট ভাঙতে সক্রিয় ছিল তৃণমূল। ধর্মঘটের পরের ২৪ ঘণ্টাতেও একই রকম সক্রিয়তা দেখা গেল শাসক দলের! ধর্মঘটের
দিন কাজে যোগ না দেওয়া বা রাস্তায় বাস বার না করার ‘অপরাধে’ শাসক দলের হুমকির মুখে পড়তে হওয়ার অভিযোগ এল বহু জেলা থেকে। কোথাও আবার পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ এল পুলিশের বিরুদ্ধেও। ধর্মঘটের দিন যাঁরা আক্রান্ত হয়েছিলেন, তাঁদেরই অনেকের বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টা-সহ জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা রুজু করেছে পুলিশ! স্বভাবতই এই প্রবণতার বিরুদ্ধে সরব হয়েছে বামেরা।
যেমন মুর্শিদাবাদ। ধর্মঘটের দিন সেখানে বহরমপুর, খড়গ্রাম, হরিহরপাড়ায় তৃণমূলের লোকজন ও পুলিশের হাতে মার খেয়েছিলেন সিপিএমের নেতা-কর্মীরা। অথচ জামিন-অযোগ্য ধারায় মামলা দিয়ে পুলিশ তাঁদেরই গ্রেফতার করেছে বলে অভিযোগ সিপিএমের! মারধর, সরকারি সম্পত্তি নষ্ট, সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার মতো বেশ কিছু অভিযোগে বুধবারই সিপিএমের মুর্শিদাবাদ জেলা কমিটির সদস্য সুদীপ্ত বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ পাঁচ জনকে পুলিশ গ্রেফতার করে। একই ভাবে খড়গ্রামে গ্রেফতার করা হয় প্রাক্তন বিধায়ক বিশ্বনাথ মণ্ডল-সহ সিপিএমের ৮ জনকে। যদিও বহরমপুরে সিপিএমের প্রাক্তন সাংসদ মইনুল হাসান এবং হরিহরপাড়ার বিধায়ক ইনসার আলি-সহ বাম নেতা-কর্মীদের মারধরে অভিযুক্ত শাসক দলের কাউকেই পুলিশ ধরেনি! সিপিএমের জেলা সম্পাদক মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য তাই বলেছেন, ‘‘পুলিশ ও তৃণমূলের হাতে আক্রান্ত হলাম আমরাই। যারা মারল, তারা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে! আর পুলিশ মিথ্যে মামলা দিয়ে আমাদের দলের নেতা-কর্মীদের ফাঁসিয়ে দিল!’’
বীরভূমের মহম্মদবাজারেও সিপিএমের জোনাল কার্যালয়ে তৃণমূল হামলা চালায় বলে অভিযোগ। ইট ও লাঠির ঘায়ে আহত হন সিপিএম বিধায়ক ধীরেন বাগদি-সহ অনেকে। সিপিএম রাতেই থানায় অভিযোগ দায়ের করে। পাল্টা অভিযোগ জানায় তৃণমূল। শাসক দলের অভিযোগের ভিত্তিতেই বিধায়ক, জোনাল সম্পাদক-সহ সিপিএমের একাধিক নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টার (৩০৭ ধারা) মামলা রুজু করেছে পুলিশ। কিন্তু বামেদের দায়ের করা অভিযোগের ভিত্তিতে খুনের চেষ্টা তো নয়ই, বরং তুলনায় অনেক লঘু ধারায় পুলিশ মামলা করেছে বলে অভিযোগ। ধীরেনবাবুর কটাক্ষ, ‘‘শাসক দলের কথামতোই পুলিশ মামলা সাজিয়েছে। না হলে পুলিশ অফিসার ও কর্মীদের যে চাকরি করতেই অসুবিধা হবে!’’ পুলিশ কর্তারা অবশ্য পক্ষপাতের অভিযোগ উড়িয়ে দিচ্ছেন। তাঁরা বলছেন, বর্ধমানের আউশগ্রামে সিপিএম-তৃণমূল সংঘর্ষের ঘটনায় শাসক দলেরই তিন কর্মীকে ধরা হয়েছে। ধৃতদের বিরুদ্ধে বোমা ছোড়া, অস্ত্র আইন, অগ্নি সংযোগ ও বেআইনি জমায়েত করার মামলাও রুজু হয়েছে।
পুলিশের বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগের পাশাপাশিই ধর্মঘটীদের ‘শিক্ষা’ দিতে তৃণমূলের স্থানীয় নেতৃত্বের বিশেষ তৎপরতাও চোখে পড়েছে এ দিন। ধর্মঘটের দিন বাস না চালানোয় এ দিন গাড়ি চালাতে বাধা দেওয়ার অভিযোগ এসেছে বেশ কিছু জায়গা থেকে। এমনকী, আস্ফালনের নজির দেখা গিয়েছে খাস কলকাতাতেও। উল্টোডাঙার একটি প্রতিষ্ঠিত বিপণি ধর্মঘটের দিন বন্ধ রাখায় পরের দিন স্থানীয় তৃণমূল কাউন্সিলরের নাম করে ওই বিপণিকে সমঝে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে বলে অভিযোগ মিলেছে। নাগরিকদেরই একাংশ বলছেন, মানুষের জীবনের সব ক্ষেত্রে মাতব্বরি করতে গিয়েই পতন নেমে এসেছিল বাম জমানার! তৃণমূলের আমলে অনেক কম সময়ের মধ্যেই সেই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে! ক্ষেত্রবিশেষে নিয়ন্ত্রণ করার প্রবণতা ছাড়িয়ে যাচ্ছে পূর্ববর্তী আমলকেও। শাসক দলের তরফে অবশ্য সব অভিযোগই উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আনুষ্ঠানিক ভাবে কেউ মুখ না খুললেও তৃণমূল সূত্রে বলা হয়েছে, যেখানে যতটুকু ঘটনা ঘটেছে, তার প্রায় সবই ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া।
বিরোধী দল হিসেবে বামেরা অবশ্য শাসক দলের এই আস্ফালনকেই প্রতিবাদের হাতিয়ার করেছে। ধর্মঘটের দিন পুলিশ ও শাসক দলের হামলার প্রতিবাদে এ দিন রাজ্যের সর্বত্র মিছিল হয়েছে। কলকাতায় সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার থেকে এন্টালি পর্যন্ত প্রতিবাদ মিছিলে ছিলেন ১৭টি বাম দলের নেতারা। মিছিলে ভিড় হয়েছিল ভালই। ধর্মঘট করার জেরে পুলিশ ও শাসক দলের আচরণ প্রসঙ্গে মিছিল শুরুর আগে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী ভয় পেয়েছেন। যত ওঁরা এ সব করবেন, প্রতিবাদ-প্রতিরোধ তত বাড়বে!’’ আর মিছিল শেষে বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসুর বক্তব্য, ‘‘মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার আক্রান্ত। প্রয়োজনে প্রাণ দিতে হবে। তবু গণতন্ত্র বাঁচাতে আমাদের লড়াই চলবে।’’ ধর্মঘটের নামে বামেদের ‘গুন্ডামি’র প্রতিবাদে তৃণমূলেরও ধিক্কার মিছিল ছিল এ দিন। তবে কলকাতা-সহ কোথাওই সেই কর্মসূচি ঘিরে শাসক দলে তেমন উদ্দীপনা চোখে পড়েনি।
হুগলির ধনেখালিতে ধর্মঘটের দিন অনুপস্থিত শ্রমিকদের কাজে নেওয়া যাবে না, তৃণমূলের এই ‘ফরমানে’ বিবাদের জেরে একটি বিয়ার কারখানায় উৎপাদনই বন্ধ হয়ে গিয়েছে! ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে এ দিন কারখানা চত্বরে মারপিট হয় তৃণমূল সমর্থক এবং শ্রমিকদের একাংশের মধ্যে। কারখানার এক শ্রমিক ছুরির আঘাতে আহত হন। স্থানীয় বিধায়ক অসীমা পাত্র অবশ্য এই ঘটনার সঙ্গে তৃণমূলের কোনও যোগ থাকার কথা অস্বীকার করেছেন। হাওড়ার পাঁচলার গঙ্গাধরপুর বালিকা বিদ্যামন্দিরে হাজিরা খাতায় বুধবার গরহাজির থাকা শিক্ষিকাদের নামের পাশে লাল কালির ক্রস চিহ্ন মেরে দিয়েছেন স্কুলের পরিচালন সমিতির সদস্য, এলাকার তৃণমূল বিধায়কের প্রতিনিধি দিবাকর বাগ! যে কাজকে সরাসরি ‘বেআইনি’ বলেছেন প্রধান শিক্ষিকা মমতা গুহঠাকুরতা। বাঁকুড়ার মেজিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুরের দাসপুর বা হুগলির মশাটে বাস চলাচল বন্ধ করে এ দিন বিক্ষোভ হয়েছে ধর্মঘটে বাস না চলার জন্য। স্বরূপনগরের তেঁতুলিয়ায় আবার ধর্মঘটে ব্যাঙ্ক বন্ধ রাখার ‘অপরাধে’ ব্যাঙ্ক ম্যানেজারকে মারধর করার অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। হিঙ্গলগঞ্জের যোগেশগঞ্জে ৫টি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে ধর্মঘটে বন্ধ ছিল বলে এ দিন সেখানেও তালা ঝুলিয়েছে শাসক দল। যদিও তৃণমূল অভিযোগ মানেনি।