Saline Controversy

পরিকাঠামোর গলদেই কি সরকারি ওষুধ নিয়ে প্রশ্ন

ওষুধের সঙ্গে জীবন জড়িয়ে। তবু গুণমান পরীক্ষার বেহাল পরিকাঠামোয় ওষুধের মান নিয়মিত জরিপ করা সম্ভব হচ্ছে না বলে আক্ষেপ চিকিৎসক থেকে ড্রাগ কন্ট্রোলের আধিকারিকদের একাংশের।

Advertisement

শান্তনু ঘোষ

শেষ আপডেট: ২০ জানুয়ারি ২০২৫ ০৭:৫৪
Share:

— প্রতীকী চিত্র।

মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের ঘটনায় ‘রিঙ্গার্স ল্যাকটেট’ স্যালাইন এবং ‘অক্সিটোসিন’ ইঞ্জেকশন নিয়ে বিতর্ক এখন তুঙ্গে। কিন্তু শুধু ওই দু’টি ওষুধই নয়। বরং বিভিন্ন সময়ে অন‍্য ওষুধের গুণগত মান নিয়েও সরকারি হাসপাতালের অনেক চিকিৎসকই প্রশ্ন তোলেন। কিন্তু সরকারি হাসপাতালে যে ওষুধ সরবরাহ হচ্ছে, তা ব্যবহারের আগে গুণগত মান পরীক্ষার কি কোনও ব্যবস্থা নেই? একাধিক সরকারি মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষের দাবি, আসল সমস্যা সেখানেই। কারণ, ওষুধের নমুনা পরীক্ষার জন্য ‘স্টেট ড্রাগ কন্ট্রোল রিসার্চ ল্যাবরেটারি’তে পাঠানো হলেও সচরাচর রিপোর্টের অপেক্ষা করা হয় না। রিপোর্ট আসার আগেই ওই ওষুধ রোগীর প্রয়োজনে ব্যবহার করা হতে থাকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মাসের পর মাস রিপোর্ট না আসার অভিযোগও রয়েছে।

Advertisement

সেই সঙ্গে প্রাক্তন স্বাস্থ্য আধিকারিকদের একাংশের দাবি, ওষুধের গুণমান খারাপ হওয়ার নেপথ্যে রয়েছে প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলির সরকারি বরাত পাওয়ার প্রতিযোগিতা। বরাত পাওয়ার জন্য প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলি ওষুধের দামে অনেকটা করে ছাড় দেয়। কিন্তু ওষুধ তৈরির মানে নানা ভাবে আপস করা হয়। প্রাক্তন এক স্বাস্থ‍্য আধিকারিকের কথায়, ‘‘সরকারি বরাত পাওয়ার সময়ে ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলি গুণমান নিয়ে সতর্ক থাকে। কিন্তু বরাত পাওয়ার পরীক্ষায় উতরে যাওয়া ওষুধগুলির গুণগত মান বজায় রাখা নিয়ে অনেকেই পরোয়া করে না। ওষুধের নিয়মিত পরীক্ষাও তেমন ভাবে হয় না। প্রস্তুতকারী সংস্থা ব্যবসা করতে এসেছে। তাই, দাম কম পেলে ওষুধ তৈরির খরচেও তারা কাটছাঁট করে।’’ চিকিৎসক মহলের একাংশের প্রশ্ন, বিশেষ মতলবে কম দামে বা কারও ‘পছন্দের’ সংস্থার ওষুধ কিনতে গিয়ে গুণগত মানের সঙ্গে আপস করা হচ্ছে না তো?

ওষুধের সঙ্গে জীবন জড়িয়ে। তবু গুণমান পরীক্ষার বেহাল পরিকাঠামোয় ওষুধের মান নিয়মিত জরিপ করা সম্ভব হচ্ছে না বলে আক্ষেপ চিকিৎসক থেকে ড্রাগ কন্ট্রোলের আধিকারিকদের একাংশের। তাঁদের দাবি, গোটা রাজ্যের জন্য একটি মাত্র পরীক্ষাগার। বছর পাঁচেক আগে উত্তরবঙ্গে আরও একটি পরীক্ষাগার তৈরির সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু কিছুই হয়নি। রাজ্য ড্রাগ কন্ট্রোলের প্রাক্তন এক আধিকারিকের কথায়, ‘‘বছর পাঁচেক হল রাজ‍্যের পরীক্ষাগারে মাদক সংক্রান্ত পরীক্ষাও করতে হচ্ছে। সেই পরীক্ষা একদিনেই করা যায়। কিন্ত রোজ পরীক্ষার চাপ এত বেশি থাকে যে, হাসপাতালের পাঠানো ওষুধের গুণগত মান যাচাইয়ে দেরি হয়।’’ রাজ্যের ওই পরীক্ষাগারের পরিকাঠামো সংস্কারের জন্য ‘ইন্ডিয়ান ফার্মাসিউটিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন’-এর রাজ্য শাখার তরফে বার বার প্রশাসনকে জানানো হলেও, সমস্যা যে কে সেই। সূত্রের খবর, ‘স্টেট ড্রাগ কন্ট্রোল রিসার্চ ল্যাবরেটারি’তে বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল থেকে মাসে অন্তত ৩০০টি নমুনা আসে। কর্মীর অভাবে মেরেকেটে এর ২০-২৫ শতাংশ পরীক্ষা হয়। জানা যাচ্ছে, প্রায় বছর পাঁচেক ধরে ওই পরীক্ষাগারের অধিকর্তা পদে স্থায়ী ভাবে কাউকে নিয়োগ করা হয়নি। রাজ্য ড্রাগ কন্ট্রোলের এক আধিকারিক ওই পদের অতিরিক্ত দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। অনেক দামী ও উন্নত যন্ত্রপাতি স্রেফ পড়ে। ড্রাগ কন্ট্রোলের প্রাক্তন আধিকারিকেরা জানাচ্ছেন, ওই সংস্থার গবেষণারও এখন দফা রফা। ৪০-৪৫ জন টেকনিশিয়ানের জায়গায় আছেন মাত্র ১২ জন। আরও ২০ জনকে চুক্তির ভিত্তিতে নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

Advertisement

রাজ্য ড্রাগ কন্ট্রোল সূত্রের খবর, পরীক্ষাগারে বিভিন্ন নমুনা পরীক্ষার নানা প্রক্রিয়া রয়েছে। যা সময়সাপেক্ষ। যেমন ‘রিঙ্গার্স ল্যাকটেট’ স্যালাইনে কোনও ব্যাকটিরিয়া আছে কি না, বুঝতে নমুনার মধ্যে অণুখাদ‍্য (জীবাণু বৃদ্ধির সহায়ক খাদ্য) মিশিয়ে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় দশ দিন লালন করতে হয়। রাজ্যের মেডিক্যাল কলেজগুলি সূত্রের খবর, সরকারি ভাবে যে ওষুধ সরবরাহ হয়, তার ব্যাচ নম্বর নির্দিষ্ট পোর্টালে নথিভুক্ত করা হয়। দরকারে সংশ্লিষ্ট ওই ব্যাচ নম্বরের ওষুধ পরীক্ষাও করা যায়। চিকিৎসকদের একাংশের দাবি, ‘‘নিয়মমাফিক ইঞ্জেকশন থেকে স্যালাইন এবং যে কোনও ওষুধেরই নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট আসার পরে ব্যবহার করার কথা। কিন্তু রিপোর্ট সময়ে আসে না। রোগীকে ওষুধ না দিয়ে বসেও থাকা যায় না।’’

সরকারি মেডিক্যাল কলেজের পোড়খাওয়া চিকিৎসকদের অনেকেরই অভিযোগ, কিছু ক্ষেত্রে ‘বিতর্কিত’ ওষুধগুলি রাজ্যের পরীক্ষাগারে গিয়ে ‘উত্তীর্ণ’ হয়ে চলে এসেছে। রিঙ্গার্স ল্যাকটেট ব্যবহার নিয়ে ২০১৬ সালেও উত্তরবঙ্গের এক চিকিৎসক অভিযোগ তুলে ছিলেন। পরে তাঁকে অন্য একটি কারণে শো-কজ করা হয়। তাতে তিনি সরকারি চাকরি ছেড়ে দেন। আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেও ২০২৩এর জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি এবং মে— এই তিনটি মাসে ১১ জন প্রসূতির মৃত্যু হয়েছিল। ওই সময়কালের মধ্যে জরায়ুর টিউমার অস্ত্রোপচার হওয়া এক রোগীরও মৃত্যু হয়। শহরের ওই মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসক পড়ুয়া তথা জুনিয়র ডক্টর্স ফ্রন্টের অন্যতম মুখ অনিকেত মাহাতো বলেন, ‘‘২০২৩এর জুন থেকে আর জি করের স্ত্রীরোগ বিভাগে রিঙ্গার্স ল্যাকটেট (আরএল) ব্যবহার হয় না। প্রশ্ন হল কোনও অজ্ঞাত কারণে ওই প্রসূতি মৃত্যুর পরে কি ‘আরএল’ ব্যবহার বন্ধ করা হয়েছিল? আর এত প্রসূতির মৃত্যুর কারণ সেই সময়ে কেন খতিয়ে দেখেনি স্বাস্থ্য দফতর?’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement