জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃণমূল শিক্ষাবন্ধু সমিতির এই অফিস নিয়েই বিতর্ক। ছবি: রণজিৎ নন্দী।
বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বুকে একটাই দল...!
কয়েক বছর আগে রাজ্যে কোনও একটি ভোট-ফলের পরে সমাজমাধ্যমে এমন রোল উঠেছিল। রাজ্যে শাসক দলের নিরঙ্কুশ জয় উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথের কাছে মার্জনা চেয়েই বাঁধা হয় প্যারডির সুর। এ বার রবীন্দ্রনাথের জন্মভিটেতেও শাসক দলের পদচিহ্ন।
জোড়াসাঁকোর ছ’নম্বর বাড়ি বলে পরিচিত মহর্ষি ভবনে, রবীন্দ্র-জীবনে স্মরণীয় দক্ষিণের বারান্দার ঠিক নীচেই সবুজ রঙে সেজে বসত গেড়েছে শাসক দলের শিক্ষাকর্মীদের ইউনিয়ন অফিস। কলকাতা হাই কোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলায় ঐতিহ্য ভবনে বেআইনি নির্মাণ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। এর পরেই ভবনের বাইরে ইউনিয়নের বোর্ডটি সরিয়ে ফেলা হয় বলে জোড়াসাঁকোর বাড়ি তথা রবীন্দ্রভারতী ক্যাম্পাসের অন্দরমহলের খবর। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য সব্যসাচী বসু রায়চৌধুরী নিজে এই নির্মাণকাজ ‘গর্হিত’ বলে মেনে নিয়ে এর পিছনে কোনও প্রশাসনিক অনুমতি থাকার বিষয়টি অস্বীকার করছেন। কিন্তু শাসক দলের অনুগামী শিক্ষাবন্ধু সমিতির রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিটের দাবি, যা হয়েছে, নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া মেনে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুমতিক্রমেই হয়েছে।
রবীন্দ্রভারতীর আজকের জোড়াসাঁকো ক্যাম্পাসে ছ’নম্বর বাড়ির ‘দক্ষিণের বারান্দা’র কথা উঠে এসেছে রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনস্মৃতি’তেও। বিভিন্ন রবীন্দ্রগান সৃষ্টির পটভূমিতে ওই বারান্দা স্বয়ং যেন একটি চরিত্র। রবীন্দ্রনাথের নিজের ভাষায়, ‘জোড়াসাঁকোর বাড়ির প্রাণের একটি ঝরনাতলা ছিল এইদক্ষিণের বারান্দা!’ তার ঠিক নীচেই মহর্ষি-ভবনের একটি ঘর ‘দখল’ করে ওই তল্লাটটি কী ভাবে অন্য রং করে ইউনিয়ন অফিস তৈরি হল, তা নিয়েও নানা মহলে প্রশ্ন উঠছে। উপাচার্য বলছেন, ‘‘আমার জ্ঞানত ওই বাড়ির কোনও ঘরে নির্মাণকাজ করা যায় না। আমি এর কোনও প্রশাসনিক অনুমতি দিইনি। টাকার সংস্থানও করিনি। এমন কাজ হচ্ছে, তা আমায় বলা হলেও আমি কিছু প্রশাসনিক নির্দেশ দিয়েছিলাম। দুর্ভাগ্য তা বাস্তবায়িত হয়নি।’’
বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মীদের একাংশই বলছিলেন, দক্ষিণের বারান্দার নীচের অংশের দালান, দু’টি ঘর ইচ্ছামতো রং করা ছাড়াও ঘরের মেঝের স্তর পাল্টানো হয়েছে। তৃণমূল শিক্ষাবন্ধু সমিতির রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিটের সভাপতি সুবোধ দত্তচৌধুরীর কথায়, ‘‘আমরা স্রেফ নিজেদের ইউনিয়নের জন্য বসার জায়গা চেয়েছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসচিবের কাছে চিঠি দিয়ে অনুমতি নিয়েছি। বাড়তি নির্মাণ হয়নি। ঘরটি সাফসুতরো করা হয়েছে। বাম আমল বা আগেও ওই ঘরেই ইউনিয়ন ছিল। এখন অহেতুক রাজনীতি হচ্ছে।’’ ঠাকুরবাড়িতে ঐতিহ্য তছনছের অভিযোগ প্রসঙ্গে রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের সদস্য তথা ঐতিহ্য স্থপতি পার্থরঞ্জন দাশ বলেন, ‘‘বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ডাকলে আমরা অবশ্যই বাড়িটিতে কী হয়েছে, সে-বিষয়ে মতামত দিতে পারি!’’
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক মহলের একাংশ বলছে, ক্যাম্পাস রক্ষণাবেক্ষণের ঠিকাদারকে চাপ দিয়ে ঘর দু’টি ঢেলে সাজানো হয়েছে। তাদের দাবি, ওই ঘরে ঠাকুরবাড়ির নবনির্মিত গ্যালারি সংক্রান্ত কিছু কাজ হত। পাশাপাশি বিটি রোড ক্যাম্পাসেও ইউনিয়নের ঘর ঢেলে সাজানো হয়েছে। সে-ঘরের ভিতরে পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রিলিফ ভাস্কর্য। বাইরে বিশ্ববাংলার বৃহৎ ‘ব’ও নির্মিত। জোড়াসাঁকোয় ইউনিয়নের ঘরটিতে এখন দেওয়াল জুড়ে মমতা ও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দু’টি ছবি। তাঁদের মাঝে রয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। সুবোধ হাসছেন, ‘‘কর্মচারীদের ইউনিয়ন করায় কিসে অন্যায়! মাথার উপরে রবীন্দ্রনাথ রয়েছেন, হৃদয়ে মমতাই!’’