সার সার আখড়া। কোনটায় বাউল গান হচ্ছে, কোথাও বসেছে কীর্তনের আসর। তারই মাঝে একটিকে ঘিরে মেতেছেন হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ। জয়দেবের কেঁদুলি মেলায় হরিদাস আশ্রমে তাই গড়ে উঠেছে সম্প্রীতির অনন্য নজির।
যদিও সরকারিভাবে তিনদিনের এই মেলার ঘোষণা হবে আজ দুপুরে, কিন্তু মকর স্নান উপলক্ষ্যে বুধবার দুপুর থেকেই পুণ্যার্থীরা আসতে শুরু করেছেন। জমে উঠেছে তাই ঠাকুর হরিদাস আশ্রম। আশ্রমটি কবি সাংবাদিক কুমুদকিঙ্কর ১৯৬৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেন। তখন থেকেই রাত্রিবাসের ব্যবস্থা-সহ দু’দিন দুপুরে মোচ্ছব খাওয়ার ব্যবস্থা হয়। এখনও সেই রীতিই চলছে। এখনও আশ্রমে চলছে সাহিত্যের আসর, বাউল গান এবং কীর্তন।
ওই আশ্রমকে দেখভালের জন্য ১৯৮৯ সালে কুমুদকিঙ্কর প্রয়াত হওয়ার পর তাঁর ইচ্ছানুসারে একটি ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করা হয়। ওই বোর্ড আশ্রম এলাকায় কয়েকটি দোকান ঘর ভাড়া দিয়েছে। সেখান থেকে যা আয় হয়, তা থেকে আশ্রমের কাজ চলে। ট্রাস্টি বোর্ডের সম্পাদক শান্তি কুমার রজক। তিনি বলেন, “কুমুদকিঙ্কর অনুগামী হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের কিছু ব্যক্তিকে নিয়ে ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করা হয়েছে। ট্রাস্টির আয় ছাড়াও মেলায় মোচ্ছবের জন্য স্থানীয় চাষিরা সাধ্য মতো ফসল দেন। সামান্য কিছু চাঁদাও ওঠে।” বর্তমানে ওই আশ্রমের সর্বক্ষণের দায়িত্বে যিনি রয়েছেন, তিনি ট্রাস্টি বোর্ডের অন্যতম সদস্য প্রাক্তন সেনাকর্মী অসিত সরকার।
ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য, সাংস্কৃতিক ব্যক্তি আনারুল হকের দাবি, “জয়দেব মেলায় ১৪৬ টি আখড়া বসে। তার মধ্যে একমাত্র হরিদাস আশ্রমেই উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ যুক্ত রয়েছেন। সম্প্রীতির এ এক অনন্য নজির।” আশ্রম সূত্রে জানা যায়, কুমুদকিঙ্করের জন্ম মুসলিম পরিবারে। পরে তিনি বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করেন। তার পরেই তিনি জয়দেবে ঠাকুর হরিদাস আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। পাশাপাশি তিনি ‘চণ্ডীদাস’ নামে একটি সাপ্তাহিক সংবাদপত্র চালাতে শুরু করেন। এখন অবশ্য সেটি বন্ধ। তবে প্রতি বছর বেশ কয়েকটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয় পত্রিকার।
কলকাতা পুলিশের কর্মী গৌতম রায় অসুস্থ অবস্থায় বুধবার দুপুরে আশ্রমে চলে এসেছেন। বললেন, ছেলে বেলা থেকেই মায়ের সঙ্গে মেলায় এসে এই আশ্রমেই উঠেছি। এটাই আমার নিরাপদ জায়গা।” একইরকমভাবে মেলায় এসে, এই আশ্রমে এসে উঠেছেন সিউরির চান্দনি পাড়ার অর্চনা দে। তিনি বলেন, “এই আশ্রমের আন্তরিকতায় আমি মুগ্ধ। তাই গত সাত বছর ধরে মকর স্নান করতে এসে এখানেই উঠি।”
হরিদাস আশ্রমে মেলার প্রথম দিন দুপুরে বীরভূম সাহিত্য পরিষদের আসর বসে। এ বার ৩২ বছরে পা দিল সেই আসর। প্রতি বছরই এই আসর থেকে বীরভূমের প্রয়াত লেখক-লেখিকার নামে ৬টি স্মৃতি পুরস্কার দেওয়া হয়। এবারও ৬ জন সাহিত্যসেবীকে ওই পুরস্কার দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন বীরভূম সাহিত্য পরিষদের প্রবীণ কর্ণধার কিশোরী রঞ্জন দাশ। তিনি বলেন, “আমরা এই আশ্রমে দলবল নিয়ে সাহিত্য সভা করতে এসে মোচ্ছব খাই। তাতে তৃপ্তি পাই সবাই।”