পুরনির্বাচনের সংরক্ষণকে কেন্দ্র করে গত দু’মাস ধরে একটানা চলতে থাকা বিভ্রান্তি ও দোলাচলের অবসান হল মঙ্গলবার। এ দিন নির্বাচন কমিশনের চূড়ান্ত সংরক্ষণ তালিকা প্রকাশের পরে নতুন করে হা-হুতাশ করতে হল বহু নেতাকেই। আবার অনেকের ঠোঁটের ঝুলে থাকল মুচকি হাসি।
গত জানুয়ারিতে নির্বাচন কমিশন থেকে বাঁকুড়া জেলা প্রশাসনের কাছে আসা পুরভোট সংরক্ষণ সংক্রান্ত একটি খসড়া তালিকা থেকে শুরু হয় বিভ্রান্তি। প্রশাসনিক ভাবে সেই তালিকা প্রকাশিত করা না হলেও তালিকার ‘নকল’ জেলার বাঁকুড়া, বিষ্ণুপুর ও সোনামুখী পুরসভার অনেক কাউন্সিলরের হাতে হাতে কী ভাবে পৌঁছে গিয়েছিল। সেই তালিকায় নিজের ওয়ার্ডকে সংরক্ষিত হতে দেখে চক্ষু চড়কগাছ হয়ে পড়ে বহু কাউন্সিলরেরই। সংরক্ষিত ওয়ার্ডের তালিকা দেখে শাসক দলের বহু কাউন্সিলর ও তাঁদের অনুগামীরা বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনেছিলেন। এই পরিস্থিতিতেই জেলা প্রশাসন ওই তালিকাকে মিথ্যা বলে দাবি করে চলতি মাসের শুরুতে একটি খসড়া তালিকা প্রকাশ করে।
সেখানেও পুরনো তালিকায় থাকা বহু ওয়ার্ডই সংরক্ষণের বাইরে পড়ে। এতে শাসক দলের একশ্রেণির কাউন্সিলররা স্বস্তি পেলেও অনেকেই এর মধ্যে অস্বস্তিতে পড়ে যান। জেলাশাসক অবশ্য প্রশাসনিক ভাবে প্রকাশিত তালিকাটিই খসড়া বলে জানান। ওই তালিকায় সংরক্ষিত ওয়ার্ডগুলি নিয়ে নানা অভিযোগ তোলেন বিরোধীরা। ব্যক্তিগত ভাবে শাসক দলের বহু কাউন্সিলরও ওই তালিকা নিয়ে সমালোচনা শুরু করেন। তবে প্রকাশ্যে শাসকদলের কেউ এ নিয়ে টু শব্দটি করেননি। কিন্তু চূড়ান্ত তালিকা দেখে অনেকে আর নিজেদের ক্ষোভ চেপে রাখতে পারলেন না।
খসড়া তালিকায় আঁচ ছিলই। চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের পরে দেখা গেল, সংরক্ষণের গেরোয় এ বার বিষ্ণুপুর পুরসভার ১১ নম্বর ওয়ার্ড হাতছাড়াই হল এই ওয়ার্ডের দীর্ঘদিনের কাউন্সিলর তথা পুরসভার পুরপ্রধান শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের। আগের খসড়া তালিকায় এই পুরসভার উপপুরপ্রধান বুদ্ধদেব মুখোপাধ্যায়েরও নিজের ৯ নম্বর ওয়ার্ডটি সংরক্ষণের আওতায় পড়েছিল। তবে এ দিনের প্রকাশিত চূড়ান্ত তালিকায় এই ওয়ার্ড সংরক্ষণের বাইরে চলে আসে। এই খবর ছড়িয়ে পড়ায় উল্লসিত বুদ্ধবাবুর অনুগামীরা। খসড়া তালিকায় এই পুরসভার ১২ নম্বর ওয়ার্ড সংরক্ষণের বাইরে ছিল। তবে বেশ কিছু দিন ধরেই ওয়ার্ডটি সংরক্ষণের আওতায় আসতে চলেছে বলে এলাকাবাসীর মধ্যে জল্পনা দানা বেঁধেছিল। স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ তা আটকাতে প্রায় ১০০০ জনের হস্তাক্ষর করা স্মারকলিপি জেলাশাসকের দফতরে জমা দিয়েছিলেন। যদিও শেষ পর্যন্ত ওয়ার্ডটি তফশিলি জাতির জন্যই সংরক্ষিত হল। এই ঘটনার জেরে দীর্ঘ ১৯৯৫ সাল থেকে একটানা ১২ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়ে আসা রবিলোচন দে-কে ভোট যুদ্ধে অপরাজিত থেকেই ওই ওয়ার্ড থেকে সরে যেতে হল। রবিলোচনবাবুর কথায়, “সাংবিধানিক নিয়ম মেনেই সংরক্ষণ হয়েছে। এখানে ব্যক্তিগত ভাবে আমার কোনও আপত্তি নেই।”
সংরক্ষণের খসড়া তালিকায় বাঁকুড়া পুরসভার ৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ড তফশিলি জাতির জন্য সংরক্ষিত হওয়ায় প্রকাশ্যেই ক্ষোভের কথা জানিয়েছিলেন দীর্ঘ ২৫ বছরের কাউন্সিলর ও বাঁকুড়ার প্রাক্তন পুরপ্রধান শান্তি সিংহ। চূড়ান্ত তালিকাতেও ওই তিনটি ওয়ার্ড সংরক্ষণের আওতায় পড়েছে। শান্তিবাবু বলেন, “আমার ব্যক্তিগত অভিমত সংরক্ষণ তালিকা সঠিক হয়নি। তবে দল যেহেতু প্রতিবাদ করেনি, তাই আমিও প্রশাসনের কাছে কোনও অভিযোগ জানাইনি।”
চূড়ান্ত তালিকা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সিপিএমের বাঁকুড়া জোনাল কমিটির সম্পাদক প্রতীপ মুখোপাধ্যায়। তাঁর অভিযোগ, “সংরক্ষণ নিয়ে আমাদের আপত্তিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। পুর আইন অনুযায়ী কোনও ওয়ার্ড পরপর দু’বার সংরক্ষণের আওতায় আসতে পারে না। অথচ বাঁকুড়ার ৫ ও ২১ নম্বর ওয়ার্ড গতবার ও এ বার দু’বারই মহিলা সংরক্ষিত হল।” বিজেপির বাঁকুড়া জেলা মুখপাত্র অজয় ঘটকেরও অভিযোগ, “শাসক দল নিজের মতো করে সংরক্ষণ তালিকা বানিয়েছে।”
জেলা শাসক বিজয় ভারতী অবশ্য দাবি করেছেন, “সর্বদল বৈঠক করে সবার মতামত নিয়েই সংরক্ষণের তালিকা তৈরি হয়েছে। যাঁরা আপত্তি তুলেছিলেন তাঁদের সংরক্ষণের কারণ বুঝিয়েছি। এই তালিকাই চূড়ান্ত।।”