মমতার সঙ্গে রিয়া-রাইমা, বাঁধ ভাঙল জনতা

রেল ফটক দুয়ারে গেট পড়ল। ১ ও ২ নম্বর রেল লাইনের একটিতে প্যাসেঞ্জার ট্রেন, অন্যটিতে মালগাড়ি দাঁড়িয়ে। রেল ফটক বন্ধ। হাসফাঁস অবস্থা। এই সমস্যা দীর্ঘদিনের। ভোট আসে যায়। নলহাটিবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি রোডওভার ব্রিজ তৈরি করে দেয়নি কেউই। ফলে যানজটে নাকাল হন নিত্যযাত্রী থেকে সকলেই।

Advertisement

অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়

নলহাটি শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০১৪ ০০:৩৮
Share:

নলহাটির সভায় ঢল মেনেছে মানুষের।

রেল ফটক দুয়ারে গেট পড়ল। ১ ও ২ নম্বর রেল লাইনের একটিতে প্যাসেঞ্জার ট্রেন, অন্যটিতে মালগাড়ি দাঁড়িয়ে। রেল ফটক বন্ধ। হাসফাঁস অবস্থা। এই সমস্যা দীর্ঘদিনের। ভোট আসে যায়। নলহাটিবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি রোডওভার ব্রিজ তৈরি করে দেয়নি কেউই। ফলে যানজটে নাকাল হন নিত্যযাত্রী থেকে সকলেই।

Advertisement

এই দাবি কবে পূরণ হবে তার ঠিক নেই। তাই বলে দিদির ডাক। দ্রুত সভাস্থলে যেতেই হবে। ঝুঁকি নিয়েই রেললাইন টপকে ছোটছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে শয়ে শয়ে মানুষ সভাস্থল নলহাটির হরিপ্রসাদ হাইস্কুল মাঠের দিকে রওনা দিলেন। শুক্রবার সকাল ৮টা থেকে মানুষের লাইন শুরু হয়েছে। রোদের প্রখরতা যত বেড়েছে একই মুখে লাইন দিয়ে মানুষের ঢল যেন তত বাড়ছে। সভাস্থলে পৌঁছে সেই মানুষগুলো আরও বিপদে পড়ল। দিদিকে বিশেষত বাঁকুড়ার কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী মুনমুন সেনের দুই কন্যা রাইমা ও রিয়াকে দেখতে গেলে কোথায় কোন জায়গায় ঠাঁই নেওয়া যায়, তাই নিয়েই চিন্তিত হয়ে পড়লেন সকলে। হাইস্কুলের মাঠের প্রায় অর্ধেক অংশ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হ্যালিক্যপ্টর নামার জন্য ঘিরে নেওয়া হয়েছে। বাকি অংশের মধ্যে মূলমঞ্চ থেকে চারদিক কুড়ি মিটার করে দূরত্ব বজায় রেখে বাঁশের ব্যারিকেড করে ঘিরে দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে মহিলাদের জন্য আলাদা ব্যারিকেড।

এই অবস্থায় নলহাটেশ্বরী মন্দিরের পাশ দিয়ে কোটাতলা যাওয়ার রাস্তায় দাঁড়াবার জায়গা নেই। অগত্যা নলহাটেশ্বরী পাহাড়ের উপর বসার জন্য জায়গা খুঁজে নেওয়া। কিন্তু সেখানেও তো নীচ থেকে উপর পর্যন্ত নেই নেই করে দশ হাজার লোক বসে। ঘুরপথে মাঠের পশ্চিম দিকে হাঁটা। সেখানেও পুরনো হোস্টেল ভবন থেকে আশপাশ চত্বরেও দাঁড়ানোর জায়গা নেই। একটু এগিয়ে পুকুরপাড়। পুকুরের জল কিছুটা শুকিয়েছে। তাতে কী যায় আসে। রিয়া-রাইমাকে দেখার জন্য পুকুরের হাঁটু জলেও দাঁড়িয়ে পড়লেন বাসিন্দারা। সভাস্থলে তাঁদের আসতে তখনও দেড়ঘণ্টা দেরি ছিল। দুপুর সাড়ে ১২টাতেই এই অবস্থা। ভিড় সামাল দিতে সভামঞ্চ থেকে তৃণমূলের নেতা আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়, বিপ্লব ওঝা, ত্রিদিব ভট্টাচার্যরা একাধিকবার মাইকে ঘোষণা করছেন, ‘ছোট মাঠে সভা ডাকার জন্য আমরা আপনাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। তবে এই প্রচন্ড দাবদাহে আপনাদের উপস্থিতিই জানিয়ে দিচ্ছে, আগামী দিনে আমাদের জয় নিশ্চিত।’ দুপুর দেড়টা সভাস্থলে প্রায় চল্লিশ হাজার লোক উপস্থিত। মুখ্যমন্ত্রীর হেলিকপ্টার তখনও এসে পৌঁছয়নি। মঞ্চের পশ্চিম দিকে বাঁশের ব্যারিকেডে লোক চেপেছে। মঞ্চে তখন উপস্থিত শতাব্দী রায়। বাঁশে বাঁধা মাইক নড়ছে। তার ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম।

Advertisement

মঞ্চ থেকে মাইকে বিপ্লব ওঝা বলে উঠলেন, “কী করছেন কী আপনারা? আপনারা তো তৃণমূলের সৈনিক। যা করছেন তা দেখে মনে হচ্ছে, আপনারা সিপিএমের লোক।” এলাকায় এসপি রশিদ মুনির খান পৌঁছলেন। পৌঁছলেন বর্ধমান রেঞ্জের ডিআইজি লক্ষ্মীনারায়ণ মিনা। ততক্ষণে ব্যারিকেড ভেঙে পড়েছে। সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হল উপস্থিত লোকেদের। মঞ্চে বক্তব্য রাখছেন শতাব্দী রায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই উপস্থিত হলেন তৃণমূলের বাঁকুড়া জেলা সভাপতি অরুপ চক্রবর্তী। পিছনে পিছনে সাদা রঙের রিয়া-রাইমা। মঞ্চে উঠতেই শতাব্দী রায় খুশিতে দুই বোনকে কাছে ডেকে বসিয়ে নিলেন। রাইমা-রিয়া এগিয়ে মঞ্চের সামনে এসে হাত নাড়াতে নাড়াতে মঞ্চের চারিদিক ঘুরলেন। রিয়া-রাইমার উপস্থিতি মাইকে ঘোষণা হতেই সভার মাঠে শোরগোল পড়ে গেল। হাততালিতে ভরে গেল গোটা মাঠ। রাইমা বললেন, “আমি মায়ের জন্য বাঁকুড়াতে প্রচারে এসেছি। মা মমতাদিদির জন্য লড়াই করছে। দিদি আপনাদের জন্য অনেক কিছু করছেন। আপনারা এখানে শতাব্দী রায়কে ভোট দিন।” এ বার রিয়ার ডাক। “নমস্কার আর শুভ নববর্ষ। আমি সুচিত্রা সেনের নাতনি। আর মুনমুন সেনের মেয়ে। আজকে আমি এখানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য এসেছি। আপনরা টিএমসিকে ভোট দেবেন।”

সিউড়ির মঞ্চে ওঠার আগে দলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী।
কাছ থেকে রিয়া-রাইমাকে দেখতে ব্যারিকেড ভাঙলেন মহিলারা।

ঘড়িতে দুপুর ২ বেজে ৫ মিনিট। মঞ্চে এলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বক্তব্য রাখতে গিয়ে মাইক নিয়ে দলীয় কর্মীদের ধমক দিলেন তিনি। শারীরিক অসুবিধার কথা জানিয়ে ২৫ মিনিট বক্তব্য রাখলেন। তুলে ধরলেন উন্নয়নের ফিরিস্তি। বললেন, “প্রার্থী শতাব্দী এখানে আছে এবং শতাব্দী আপনাদের কিন্তু ছেড়ে যায়নি কখনও। সারাক্ষণ কাজ করে। আপনাদের বলি বন্ধু, আমার সংখ্যালঘু ভাইবোন নলহাটিতে অনেক আছে। ১৭ শতাংশ সংরক্ষণ করে দিয়েছি আমার সংখ্যালঘু ভাইবোনদের জন্য। যেটা ওবিসির মধ্য দিয়ে প্রায় সাড়ে ৯৪ শতাংশ সংখ্যালঘু ভাইবোনেরা যারা চাকরি এবং শিক্ষায় সংরক্ষণ পাবে। আমরা ৫০০টি মার্কেটিং সেন্টার করছি। যাতে পাঁচলক্ষ ছেলেমেয়েদের দোকান দেব।” বিরোধী রাজনৈতিক দলকে আক্রমণ করেন মুখ্যমন্ত্রী। নলহাটির সভার উপস্থিত ছিলেন পরিবহণ মন্ত্রী মদন মিত্র। তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি এখানে উপস্থিত না থাকলেও সিউড়িতে ছিলেন।

নলহাটির পরেই রাইমা, রিয়াকে নিয়ে রওনা দিলেন সিউড়ির দিকে। সেখানেও সিউড়ি নির্বাচনী সভায় বলেছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়. এদিন ওঁর সঙ্গে জন সভায় হাজির ছিলেন বাঁকুড়া কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী মুনমুন সেনের দুই কন্যা রিয়া ও রাইমা সেন. ছিলেন বীরভূম ও বোলপুর কেন্দ্রের দুই প্রার্থী যাঁদের সমর্থনে প্রচারসভা সেই শতাব্দী রায় ও অনুপম হাজরা. দুপুর আড়াইটে নাগাদ সিউড়ির চাঁদমারি সভাস্থল সংলগ্ন মাঠে কপ্টারে করে নামলেন মুখ্যমন্ত্রী। যখন মঞ্চে আসেন সকলে, তখন সভাস্থলে ঠসা ভিড়। বাঁধ ভেঙে ডি ব্লকের মধ্যে ঢুকে পড়ে বহু লোকজন। সামনে মহিলাদের বসার জায়গা ছিল। মমতাই মেয়েদেরকে ওখানে এসে বসতে বলেন। কিছুটা বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। সামাল হিমসিম খায় পুলিশ। ভিড় সামাল দিতে মাঠে নামতে হয় অনুব্রত মণ্ডলকেও। কিন্তু তাতেও কাজ হচ্ছে না থেকে ভিড় যাতে বাগ মানে সেটা নিশ্চিত করতে মমতা বলতে থাকেন, “গতকাল বড় দুর্ঘটানা থেকে বেঁচেছি। গ্যাস ঢুকেছে শরীরে। চিৎকার করতে কষ্ট হচ্ছে। একটু শান্ত হন।” শান্ত হয় ভিড়। সভা শুরুর বহু আগে থেকেই ভিড় জমছিল। চাঁদিফাটা রোদে দাঁড়েয়ে বা বসে থাকাতে কষ্ট হচ্ছিল উপস্থিত লোকজনের। কেউ ছাতা, কেউ টুপি, কেউ বা শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে আপেক্ষা করছিলেন।

বিকেল সাড়ে তিনটে নাগাদ হেলিকপ্টারে সিউড়ি ছাড়লেন সকলেই। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত নলহাটি থেকে সিউড়ি জনস্রোতে ভাসল। কিন্তু নলহাটিকে তার এই হাঁসফাস অবস্থা থেকে কে কবে উদ্ধার করবে সেই প্রশ্নটা কিন্তু থেকেই গেল।

ছবি: অনির্বাণ সেন ও দয়াল সেনগুপ্ত।
সহ প্রতিবেদন: দয়াল সেনগুপ্ত।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement