এক গোষ্ঠীর শীর্ষ নেতার খুনের বদলা নিতেই রীতিমতো পরিকল্পনা করে ভাড়াটে খুনিদের সাহায্যে খতম করা হয় বিপক্ষ গোষ্ঠীর মাথাকে।
শাসক দলের গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বের ছায়া ধরা পড়ল তৃণমূলের প্রাক্তন খয়রাশোল সভাপতি অশোক মুখোপাধ্যায় হত্যাকাণ্ডের চার্জশিটে। শুক্রবার দুবরাজপুর আদালতে পেশ করা ৩৮৫ পাতার ওই চার্জশিটে নাম রয়েছে গত বছরই খুন হওয়া তৃণমূলের প্রাক্তন খয়রাশোল ব্লক সভাপতি অশোক ঘোষের ভাই দীপক ঘোষ এবং ছেলে বিশ্বজিত্ ঘোষ-সহ মোট ১৮ জন তৃণমূল নেতা-কর্মীর নাম রয়েছে। সরকারি আইনজীবী মণিলাল দে বলেন, “অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২ (খুন), ১২০খ (ষড়যন্ত্র), ২৫ ও ২৭ (অস্ত্র আইন) এবং ৯খ (বিস্ফোরক আইন) ধারা প্রয়োগ করা হয়েছে।” তিনি জানান, মামলায় পলাতক দীপক ঘোষ, বিশ্বজিত্ ঘোষ, অজিত ধীবর এবং প্রলয় চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই আদালত ওয়ারেন্ট জারি করেছে। সেই সঙ্গে তাঁদের সম্পত্তিও বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দিয়েছে। দীর্ঘ দিন জেল হাজতে থাকার পরে দিন কয়েক আগেই অভিযুক্ত আবদুর রহমান, আশিস ঘোষ, কিশোর চট্টোপাধ্যায় এবং বিশ্বরূপ চট্টোপাধ্যায় সিউড়ি জজ কোর্ট থেকে জামিন পেয়েছেন।
খয়রাশোলে তৃণমূলের দুই প্রাক্তন ব্লক সভাপতি অশোক ঘোষ এবং অশোক মুখোপাধ্যায় গোষ্ঠীর দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের। অবৈধ কয়লা কারবারের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে থাকবে, সেটাই এই দ্বন্দ্বের নেপথ্য বলে পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রেরই খবর। গত বছর অগস্ট মাসে গুলিতে খুন হন অশোক ঘোষ। ঠিক এক বছরের মাথায় একই কায়দায় খুন হন অশোক ঘোষ খুনে মূল অভিযুক্ত অশোক মুখোপাধ্যায়ও। দু’টি হত্যাকাণ্ডেই নাম জড়িয়েছে তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের।
পুলিশ সূত্রের খবর, গত ১৬ অগস্ট রাত ৮টা ২০ মিনিট নাগাদ মনসা পুজোর ফল কিনতে বেরিয়ে খয়রাশোলের পাঁচড়ায় বাড়ি থেকে একশো মিটার দূরে দুষ্কৃতীদের গুলিতে খুন হন অশোক মুখোপাধ্যায়। দু’টি মোটরবাইকে পাঁচ জন দুষ্কৃতী ওই হামলা চালিয়েছিল বলে অভিযোগ। পরের দিন দলেরই বিরোধী অশোক ঘোষ গোষ্ঠীর নেতা, কর্মী ও অনুগামী মিলিয়ে মোট ৪৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হয়েছিল। এত জন তৃণমূল নেতা-কর্মীর নাম জড়ানোয় গ্রেফতারির ক্ষেত্রে প্রথম থেকেই সাবধান ছিল পুলিশ। তবে, শাসক দলের গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বের জেরে ওই খুন, নাকি অবৈধ কয়লা সাম্রাজের দখলদারি নিয়ে বিরোধ, না খুনের পাল্টা খুন এ নিয়ে প্রথম দিকে পুলিশ বেশ সংশয়ে ছিল। যদিও কিছু দিন পর থেকেই মূলত তদন্তে নেমে দু’টি বিষয় মাথায় রেখেছে পুলিশ। এক, বদলার খুন এবং দুই, খয়রাশোলের বিপুল অবৈধ কয়লা সাম্রাজ্যের দখলদারি নিয়ে তৃণমূলের দুই গোষ্ঠীর দীর্ঘ বিবাদের ইতিহাস।
তদন্তের পরে পুলিশের দাবি, গত বছর ১২ অগস্টে খুন হয়েছিলেন অশোক ঘোষ। এ বার সেই অগস্টেই (১৬ তারিখ) খুন হন তাঁকে খুনে মূল অভিযুক্ত তৃণমূল নেতা অশোক মুখোপাধ্যায়। তাই প্রথম থকেই পাল্টা খুনের তত্ত্বে বিশ্বাস করে তদন্ত এগিয়েছে পুলিশ। খুনের পর প্রথম গত ১০ সেপ্টেম্বর আব্দুর রহমান, আশিস ঘোষ এবং কিশোর মণ্ডল নামে তিন তৃণমূল নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তিন জনের নামই এফআইআর-এ ছিল। ধৃতদের জেরা করে ১৫ সেপ্টেম্বর বিশ্বরূপ চট্টোপাধ্যায় এবং ২৭ সেপ্টেম্বর স্বপন সেন, হাবুল শেখ, লক্ষ্মীকান্ত পাল (লখাই), কেদার আলি এবং সেখ সইবুল নামে দলেরই আরও পাঁচ নেতা-কর্মী ধরা পড়ে। পুলিশের দাবি, ধৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করেই ওই সুপারি কিলারদের কথা প্রথম জানা যায়। তারপর গত ১১ অক্টোবর চার ভাড়াটে খুনি বাবলু শর্মা, পাপু ওরফে অঞ্জু সাহু, বহারুদ্দিন শেখ এবং দিলীপ কুমারকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গত ২১ নভেম্বর পটনার মালসালামি থানা এলাকার নয়াটোলা থেকে ধরা পরে ভাড়াটে খুনিদের দলের পঞ্চম সদস্য বিজেন্দ্র দাসও।
ধৃতদের জেরা করে পুলিশ জানতে পেরেছে, অশোক মুখোপাধ্যায় হত্যাকাণ্ডের ছক কষা হয়েছিল ঘটনার বহু আগেই। পুলিশের দাবি, অশোক ঘোষের খুনের বদলা নিতে দীপক ঘোষ-সহ বিরোধী গোষ্ঠীর অনেক নেতা মিলেই তার নীল নকশা তৈরি করে ভাড়াটে খুনিদের বরাত দেয়। কাজ হাসিলের জন্য পাঁচ জনের ওই সুপারি কিলারদের প্রত্যেককে ৯০ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে বলে চুক্তি হয়েছিল। এ ছাড়াও কাজের শেষে তাদের প্রতি মাসে দশ হাজার টাকা করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছিল। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ঘটনার সাত দিন আগে থেকেই ওত পেতে ছিল হামলাকারীরা। কিন্তু পুলিশ তত্পর থাকায় ১২ অগস্ট খুন করা সম্ভব হয়নি। এর পরেও খুনের চেষ্টা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত তৃতীয় বার আততায়ীদের লক্ষ্য পূরণ হয়। কাজ হাসিল করে রাতটা খয়রাশোলে এক তৃণমূল নেতার আশ্রয়ে কাটিয়ে প্রথমে সিউড়ি এবং সেখান থেকে ট্রেনে দুর্গাপুর পৌঁছে প্রাপ্য টাকা জন্য অপেক্ষা করছিল আততায়ীরা। সেখানে দিন দুই কাটানোর পরে টাকা পেয়ে তারা বিভিন্ন এলাকায় গা ঢাকা দেয় বলে পুলিশ জানিয়েছে।
যদিও তৃণমূল জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল প্রথম থেকেই ওই ঘটনায় দলের গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বের কথা অস্বীকার করে আসছিলেন। এমনকী, দীপকবাবুদের নামে এফআইআর হওয়ায় বিস্ময়ও প্রকাশ করেছিলেন। এ দিন ফোন করা হলে অনুব্রত বলেন, “এ নিয়ে আমি কোনও মন্তব্য করব না।”