Society

গণেশ-জননী: আগলে রাখেন যিনি

কোপাইয়ের পাড়ে কাশের দোলা। ভোরে ঘাসের আগায় শিশির বিন্দু, শিউলি, শালুক জানান দিচ্ছে, ‘মা’ আসছেন। আসলে মা-দুর্গা বললেই অসুর নিধনে উদ্যত দেবীমূর্তির ছবি যেন চোখের সামনে ভাসে, তেমনই মনে হয় গণেশ-জননীর কথা। দুর্গতিনাশিনী শুধু নয়, দুর্গার অধিষ্ঠান মাতৃরূপেণ সংস্থিতাও। পরম যত্নে সন্তানকে আগলে রেখেছেন। ঠিক যেন রক্তমাংসের মা। দুর্গার এই মাতৃরূপের কাছেই তো আশ্রয় চেয়েছি বারবার! পটুয়াদের চিত্রকলা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ছোট্ট গণেশকে কোলে নিয়ে ‘গণেশ জননী’-র এমনই ছবি এঁকেছিলেন শিল্পী যামিনী রায়। চারপাশে এমন কত ‘গণেশ-জননী’ আছেন। তাঁদের ঘরে-বাইরের নিত্য লড়াই, যন্ত্রণা, দুঃখের খোঁজ কে রাখি?

Advertisement

দয়াল সেনগুপ্ত 

শেষ আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০২৩ ০৮:৩৬
Share:

ছবি: কুনাল বর্মণ।

সহজে কি ভোলা যায়!

Advertisement

শান্তিনিকেতনের মোলডাঙা। কোপাই থেকে কতটুকুই বা দূরে! ছোট্ট বাড়িতে ছুটে বেড়াত সে। পুজো এলে সে কী আনন্দ! চোখের কোণটা চিকচিক করে ওঠে মমতা ঠাকুরের। মমতায় হাত বোলান মলিন ছবিটার গায়ে। গত বছর এমনই পুজোর ঠিক আগে মমতার ছোটপুত্র, ৫ বছরের শিবম দোকানে বেরিয়ে আর ফিরল না। খোঁজ খোঁজ। কোত্থাও নেই পাড়ার প্রিয় ছেলেটা। তিন দিন পরে বস্তাবন্দি নিথর দেহ মিলল পড়শি মহিলার অ্যাসবেস্টসের ছাদ থেকে। পড়শি গ্রেফতার হলেন। মামলা চলছে। কিন্তু, শিবম আর ফিরবে না মায়ের কোলে! সে বার পুজো হয়নি মোলডাঙায়। এ বার হচ্ছে। সন্তান শোকে কাতর মমতা করে চলেছেন তাঁর নিত্য কর্তব্য। আরও একটা ছেলে আছে। তাকে বড় করতে হবে। মায়ের কত্ত কাজ! কিন্তু, থেকে থেকে ফিরে আসে শিবম, মায়ের মনে, স্মৃতিতে। “এত সহজে কি সব ভোলা যায়! জানেন, খুব হাসিখুশি, মিষ্টি ছিল আমার ছোট ছেলে। সারাক্ষণ আনন্দে থাকত। পাড়ার সবাই ওকে ভালবাসত। পুজোর সময় নতুন জামা পরে ঠাকুর দেখতে বেরোতাম সবাই মিলে। ওকে ছেড়ে এ বারও মণ্ডপে যেতে পারব না।”—গলা বুজে আসে জননীর। তার পরেই মনে পড়ে মা তো তিনি আর এক জনেরও। বলে উঠেন, “বড় ছেলেটা যাবে। ও কেন পুজোর আনন্দ করবে না?” ধরা পড়ল সন্তানহারা জননীর সন্তানের প্রতি দায়িত্ববোধ, স্নেহ। তিনি যে মা! তিনি রক্ত-মাংসের দুর্গা। দুর্গাকে দুর্গতিনাশিনী বলা হয়। যিনি সমস্ত কষ্ট লাঘব করেন। অনেকটা যেন নিশ্চিন্ত ও নিশ্চিন্ত আশ্রয়, মায়ের আঁচলের মতো। পুরাণ বিশেষজ্ঞ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি দুর্গা বিষয়ক আলোচনা করতে গিয়ে বলছেন, ‘... মা আমি কোথা থেকে এলাম’। ছোট্ট সন্তানের এই এই প্রশ্নের উত্তরে বলা হত, ‘মাতাতে পার্বতী দেবী পিতা দেব মহেশ্বর’। নৃসিংহপ্রসাদ বলেছেন, ‘আসলে দুর্গাকে আমরা মায়ের আসন দিয়েছি। যাকে সব কিছু বলা যায়। শাস্ত্রীয় ভাবে অন্য দেবতার কাছে জ্ঞান চাইছি, ভক্তি চাইছি। কিন্তু দুর্গা, যাঁর কাছে আমরা ‘রূপং দেহি জয়ং দেহি ,যশ দেহি’ বলছি। মা বলেই বোধহয় এমনটা চাওয়া যায়’।

এইটুকু করতেই হবে!

Advertisement

বাস্তবের মা যে পরিস্থিতিতেই থাকুন, সন্তানকে সুখে রাখা তাঁর সবচেয়ে বড় চাওয়া। সিউড়ির আনন্দপুরে মধ্য চল্লিশের তুলসী ধরকে দেখুন। আদতে খয়রাশোলের বাসিন্দা তুলসীর বিয়ে হয়েছিল ঝাড়খণ্ডের সুদ্রাক্ষীপুরে। স্বামী যখন মারা যান, ছেলে জয়ন্ত তখন তিন আর মেয়ে জয়ন্তী এক বছরের। বাপের বাড়িতে ফিরলেও সেখানে বেশিদিন থাকা হয়নি। উঠে আসতে হয় সিউড়ির হোমে। তুলসীর কথায়, ‘‘মেয়েদের বিয়ে হলেই তারা পর। উপায় ছিল না। তাই হোমে আসতে হল।’’ কয়েক বছর হোমে থাকার পরে সিউড়িতে ঘর ভাড়া করলেন। গৃহস্থের বাড়িতে রান্নার কাজ ধরেন। উদ্দেশ্য, ছেলেমেয়ে যেন কষ্ট না পায়। ২৪ বছর ধরে লড়াই চলছে। মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে বিয়ে দিয়েছেন। ছেলের বেশি দূর লেখাপড়া না হলেও কাজ করছে। এখনও তুলসী কিছু বাড়িতে রান্না করেন। ক্লান্তিহীন কেটে যায় রোজ। ‘‘সন্তানদের ভালর জন্য মাকে এটুকু করতেই হবে’’—বলছেন জননী।

ছেলেদের বড় করতে হবে

একটি আখ্যান আছে রামেশ্বর ভট্টাচার্যের ‘শিবায়ন’-এ। শিব ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে ফিরেছেন। কার্তিক ও গণেশ ছুটে এসেছেন। খাবারের ভাগ নিয়ে মারামারি। জিতছেন গণেশই। তবে, মা দুর্গার হস্তক্ষেপে কার্তিককেও খাবারের ভাগ দিতে শিখছেন গণেশ। ‘সুভাষিতরত্নভান্ডাগার’-এর একটি শ্লোকেও ভাইদের ঝগড়া থামাতে দেখা যায় দুর্গাকে। আসলে জন্মলগ্ন থেকেই আমাদের যাবতীয় খিদে বা চাহিদাপূরণের দায় মায়ের। সিউড়ির করমশাল গ্রামের যূথিকা মালের কথাই ধরা যাক। মধ্যে কুড়ির ওই যুবতীর স্বামী লাভলু মাল জুন মাসে ওড়িশার ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনার পর থেকেই নিখোঁজ। আবাস যোজনার বাড়ি অসম্পূর্ণ ছিল। সেটা শেষ করতে টাকা রোজগারের জন্য গ্রামের আরও কয়েক জনের সঙ্গে চেন্নাইয়ে কাজে গিয়েছিলেন লাভলু। বেশ কয়েক মাস কাজ করার পরে বাড়ি ফিরছিলেন। বালেশ্বরের বাহানগা বাজারের কাছে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনার পর থেকেই খোঁজ নেই তাঁর। দুই সন্তানকে নিয়ে দিশেহারা যূথিকা। কিন্তু, হাল ছাড়ছেন না। কাজ খুঁজছেন। মা দুর্গার কাছে প্রার্থনা করবেন, একটা কাজ জোটে যেন, ছেলেমেয়ে দু’বেলা দু’মুঠো খেতে পায় যেন। ‘‘স্বামী বেঁচে আছে না মারা গিয়েছে জানি না। সরকার ১০ হাজার টাকার চেক দিয়ছিল। সেটাও স্বামীর নামে হওয়ায় জমা দিতে পারিনি। শাক পাতা তুলে বিক্রি করে কোনওক্রমে চলছে। যে কোনও একটা কাজের চেষ্টা করছি। ছেলে দুটোকে তো বড় করতে হবে!’’—জননীর চিরন্তন লড়াই ফুটে উঠল যূথিকার গলায়।

মায়েরা নিজেদের সব টুকু উজাড় করে দেন সন্তানের হাসি দেখার জন্য। বনফুলের ‘গণেশ জননী’ তেমনই এক মা-সন্তানের কাহিনি তুলে ধরে। গল্প একটি হাতিকে নিয়ে। হাতিটি দশ বছর আগে উপহার হিসাবে প্রতিপালকের গৃহে এসেছিল। প্রতিপালক হাতিটিকে পুষবেন
কিনা ভাবছেন এমন সময় তাঁর স্ত্রী হাতিটিকে দেখে বলে ওঠেন— “ও গণেশ এসেছে’! এই বলে তাকে একবাটি দুধ এগিয়ে দেন। হাতির নাম হয় গণেশ। নিঃসন্তান দম্পতির গৃহে পুত্রস্নেহে প্রতিপালিত হতে থাকে। ‘সন্তানের’ প্রতি এই জননীর স্নেহ বিভিন্ন ভাবে প্রকাশ পেয়েছে কাহিনিতে। সন্তান-স্নেহ সেই গৃহিনীকে যথার্থ রূপেই ‘গণেশ জননী’
করে তুলেছে।

সময় কি থেমে থাকে

আসলে মাতৃরূপে দুর্গাকে দেখতে চাই বলেই আমরা মায়ের মুখ দেখি। সেখানে অসুর বা অসুর বধ গৌণ। কিন্তু, চাইলেই বাস্তবের দুর্গারা তেমনটা পারেন কই। ২০১৯ সালে এই অক্টোবরেই সদাইপুর থানা এলাকার কচুজোড়ে দুই মায়ের কোল খালি হয়ে গিয়েছিল এক লহমায়। সীমা পাল ও বাবলি পাল। দুই জা। তাঁদেরই দুই সন্তান বছর তেরোর রাজীব ও বছর পাঁচেকের সাথী বক্রেশ্বর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ছাই পুকুরে তলিয়ে গেল খেলতে গিয়ে। খুব ভাব ছিল ভাইবোনের। বড় জা সীমার আর এক পুত্র রয়েছে। আজও পুজোর সময় তাঁদের মন ভারাক্রান্ত হয়। চোখ মোছেন বারবার। বাবলি এক কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। বছর আড়াইয়ের ‘মোহর’-ই এখন দুই পরিবারের ক্ষতে প্রলেপ দিয়েছে। হয়তো এমনটাই হওয়ার ছিল। ‘‘সময় তো থেমে থাকে না’’— বলছেন দুই জা।

এক জন দাপুটে মেয়ের কত যে নাম। তাঁর একই অঙ্গে বহুরূপ। তবু, দুর্গাকে মা বলতে বাঙালির ভাল লাগে। দুর্গা তো মা-ই। জগজ্জননী।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement