লোহাট গ্রামের রাথনি টুডুর অসম্পূর্ণ বাড়ি। ছবি: সঙ্গীত নাগ
একই নামের দু’জনের জন্য বরাদ্দ হয়েছিল ইন্দিরা আবাস যোজনা প্রকল্পের দু’টি বাড়ি। দু’টি আলাদা বাড়ি তৈরি হয়েছে বলে উল্লেখ রয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের গ্রামোন্নয়ন দফতরের ওয়েবসাইটে। নাম রয়েছে পরিদর্শকেরও। পাঁচ বছর পরে প্রশাসনিক তদন্তে জানা গেল, ওই দু’জন আলাদা ব্যক্তি নয়। এক জনের নামেই বরাদ্দ করা হয়েছিল দু’টি বাড়ি। একটি অসম্পূর্ণ ভাবে পড়ে রয়েছে। অন্য বাড়িটির অস্তিত্বই নেই। পুরুলিয়া জেলার কাশীপুর ব্লকের কালীদহ পঞ্চায়েতের লোহাট গ্রামের এই ঘটনায় তাজ্জব প্রশাসনের অনেকে। সভাধিপতি সুজয় বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বেনিয়ম হলে ই-গভর্ন্যান্সে আগেই তা ধরা পড়ার কথা। কী ভাবে এটা ঘটেছে, তদন্ত কোন পর্যায়ে রয়েছে, তা দেখছি।’’
প্রশাসন সূত্রের খবর, ২০১৩-’১৪ আর্থিক বছরে লোহাট গ্রামের রাথনি টুডু নামে দু’জনের জন্য পুরুলিয়া জেলা পরিষদ ইন্দিরা আবাস যোজনা প্রকল্পে (বর্তমানে এই প্রকল্পের নাম বাংলার আবাস যোজনা) দু’টি বাড়ি বরাদ্দ করে। কিন্তু তাতে যে গোলমাল রয়েছে, কয়েকমাস আগে তা ধরেন স্থানীয় বাসিন্দা বিজেপি কর্মী হরেন্দ্রনাথ মাহাতো। তাঁর দাবি, ‘‘কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের ওয়েবসাইটে দেখি, দু’জন রাথনি টুডুর নামে দু’টি বাড়ি তৈরিতে ৭৫ হাজার টাকা করে বরাদ্দ হয়েছে। বাড়ি দু’টি শেষ করা হয়েছে বলেও উল্লেখ রয়েছে। অথচ, ওই গ্রামে রাথনি টুডু নামে এক জন বৃদ্ধাই রয়েছেন। তিনি যে বাড়ি পেয়েছেন, তা-ও অসম্পূর্ণ। অন্য জনের অস্তিত্বই নেই। সে টাকা কোথায় গেল?’’
কালীদহ পঞ্চায়েতের বর্তমান প্রধান তৃণমূলের লক্ষ্মী সরেন জানান, ওই ঘটনা সম্পর্কে তাঁরা বিডিও-র কাছে রিপোর্ট পাঠিয়েছেন। পঞ্চায়েতের সচিব যুবরাজ বাউরির দাবি, ‘‘লোহাট গ্রামে রাথনি টুডু নামে এক জন মহিলাই রয়েছেন। খোঁজ নিয়ে দেখেছি, দু’জন রাথনি টুডুর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট একটিই দেওয়া ছিল। বিডিও (কাশীপুর) সুদেষ্ণা দে মৈত্র বলেন, ‘‘তদন্তে দেখা গিয়েছে, দু’টি বাড়ির টাকা এক জনের অ্যাকাউন্টেই ঢুকেছিল। ওই উপভোক্তাকে শুনানিতে ডাকা হয়েছিল। একটি বাড়ির ৭৫ হাজার টাকা তিনি পাঁচটি কিস্তিতে প্রশাসনকে ফিরিয়ে দেবেন বলে রাজি হয়েছেন।’’
রাথনির বাড়ি অবশ্য সম্পূর্ণ হয়নি। তিনি বলেন, ‘‘বাড়ি তৈরির টাকা ব্যাঙ্কে এসেছিল বলে জানানো হয়েছিল। আর কী হয়েছে জানি না।’’ তাঁর ভাইপো অনিল মুর্মু বলেন, ‘‘আমরা ভেবেছিলাম, একটি বাড়ির জন্যই ওই টাকা দেওয়া হয়েছে। প্রশাসন বলায় বাকি টাকা ফেরত দিতে হবে।’’ কিন্তু তাঁর পিসির বাড়ি তৈরি কেন শেষ হয়নি? অনিলের জবাব, ‘‘পঞ্চায়েত থেকে বাড়ি তৈরি করছিল। কেন হয়নি, আমরা অতশত জানি না।’’
কিন্তু কিছু প্রশ্নের জবাব মেলেনি। অন্য রাথনি টুডুর নামের সঙ্গে দেওয়া বিপিএল নম্বরটি কার? কেনই বা সেই নম্বর বা দ্বিতীয় রাথনির অস্তিত্ব যাচাই করেনি পঞ্চায়েত?
পঞ্চায়েতের তৎকালীন প্রধান তৃণমূলের উত্তম মণ্ডলের দাবি, ‘‘বাড়ি তৈরির কাজ আধিকারিকেরাই সরেজমিনে দেখে রিপোর্ট দিতেন। একই অ্যাকাউন্টে দু’টি বাড়ির বরাদ্দ কী ভাবে ঢুকল— তা আধিকারিকেরাই বলতে পারবেন।’’ বাড়ি তৈরির কাজের পরিদর্শনের দায়িত্বে থাকা কালীদহ পঞ্চায়েতের তৎকালীন সচিব শঙ্কর বাউড়িকে ফোন করা হলে তিনি ব্যস্ত রয়েছেন বলে জবাব এড়িয়ে গিয়েছেন। পরে আর ফোন ধরেননি।
বিডিও বলেন, ‘‘এখন তিনটি ধাপে বাড়ি তৈরির কাজের অগ্রগতির ছবি জমা পড়ার পরে তিন কিস্তিতে টাকা দেওয়া হয়। তখন অন্য নিয়ম ছিল। আমিও তখন এখানকার বিডিও ছিলাম না।’’
তদন্তের আর্জি জানানো হরেন্দ্রনাথবাবু দাবি করছেন, ‘‘সহায় সম্বলহীন এক বৃদ্ধার কাছ থেকে টাকা ফেরত নিলেই দুর্নীতি চাপা দেওয়া যাবে না। ওই টাকা অন্য কারও পকেটে গিয়েছে কি না, তা পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হলেই জানা যাবে। প্রশাসনকে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করতেই হবে।’’
একই সুরে জেলা বিজেপি সভাপতি বিদ্যাসাগর চক্রবর্তী দাবি করেন, ‘‘পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হলেই আসল তথ্য সামনে আসছে। আমরা নিশ্চিত এ রকম দুর্নীতির নজির আরও রয়েছে। আমরা ক্ষমতায় এলে এই সমস্ত দুর্নীতির তদন্ত হবে।’’
সভাধিপতি তথা জেলা তৃণমূলের কো-অর্ডিনেটর সুজয়বাবুর পাল্টা দাবি, ‘‘প্রশাসন তো তদন্ত করছেই।’’ তিনি বলেন, ‘‘জেলা পরিষদে অভিযোগ এলে পুরো বিষয়ই খতিয়ে দেখা হবে।