গণদাবি: সেনভদ্র-কাণ্ডের প্রতিবাদ, অরণ্যের অধিকারের দাবিতে অবরোধ। সোমবার রামপুরহাটের বড়পাহাড়ি মোড়ে। নিজস্ব চিত্র
জল-জমি, জঙ্গল থেকে আদিবাসীদের উচ্ছেদের চেষ্টার প্রতিবাদে এবং উত্তরপ্রদেশের সোনভদ্রে নিরীহ আদিবাসী হত্যায় অভিযুক্তদের কঠোর শাস্তির দাবিতে সোমবার দেশ ও রাজ্যের বিভিন্ন অংশে আন্দোলনের শরিক হল বীরভূমও। সোমবার সকালে জেলার তিনটি রাস্তা অবরোধ করে আদিবাসী গাঁওতা। মহম্মদবাজার ব্লকের জয়পুর বাসস্ট্যান্ড এবং সিউড়ির আবদারপুর লেভেল ক্রসিং, এই দুটি জায়গায় রানিগঞ্জ-মোরগ্রাম ৬০ জাতীয় সড়ক এবং রামপুরহাটের তুমবুনি বড়পাহাড়ি এলাকায় দুমকাগামী রাস্তা অবরোধ করে সংগঠনের সদস্যরা।
জমায়েত করে, ধামসা বাজিয়ে ও হাতে তির-ধনুক ও বিভিন্ন দাবি সম্বলিত প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে জাতীয় সড়কে অবস্থান বিক্ষোভ শুরু হয়। ঘণ্টাখানেক চলার পরে পুলিশের হস্তক্ষেপে উঠে গেলেও আদিবাসীদের ওই কর্মসূচির জন্য তীব্র যানজট হয় ৬০ নম্বর জাতীয় সড়কে। বিপাকে পড়েন সাধারণ মানুষ। যানজট হয় তুমবুনিতেও। সংগঠনের দাবি, দেশ জুড়ে আদিবাসীদের উপরে অত্যাচার চলছেই। জমি বিবাদে ১৭ জুলাই উত্তরপ্রদেশের সোনভদ্রে ১০ জন গোন্ড আদিবাসীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। অভিযোগ, বংশানুক্রমে জমি চাষ করলেও প্রশাসনিক উদাসীনতায় কাগজে-কলমে আধিকার ছিল না সেই জমির।
জমির নথি না থাকায় একই ভাবে সম্প্রতি দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে দেশ জুড়ে লক্ষ লক্ষ বনবাসীর ভিটেমাটি হারানোর আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। আপাতত ‘লক্ষ লক্ষ বনবাসীকে ও আদিবাসীকে উচ্ছেদ করার’ নিজেদের নির্দেশে স্থগিতাদেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ। তাতে স্বস্তি মিললেও পাট্টা ছাড়া বন দফতরের জমিতে বসবাসকারী আদিবাসী, বনবাসী পরিবারগুলির কী পরণতি হয় তা নিয়ে ২৪ জুলাই রায়ের অপেক্ষায় আদিবাসী বনবাসী সমাজ। গাঁওতা নেতা রবীন সরেন জানান, আদিবাসী সংগঠনের পথে নামা সেই কারণেই।
বনবাসীদের যে যেখানে বাস করছেন, তিনিই সেই জমির মালিক হিসেবে গণ্য হবেন। ২০০৬ সালে আদিবাসী ও বনবাসীদের জঙ্গলের উপরে অধিকার নিশ্চিত করতে মনমোহন সরকার অরণ্যের অধিকার আইন এনেছিল। সেই বছর থেকে জঙ্গলের জমিতে বসবাসকারী আদিবাসী ও মূলবাসীদের ভূমি ও জমি পাট্টা দেওয়া শুরু হয়। কিন্তু, বন্যপ্রাণপ্রেমীদের কিছু সংগঠন ওই আইনের বৈধতা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করে।
আদালতের কাছে মামলাকারীদের আরও দাবি ছিল, পাট্টার আবেদন খারিজ হয়েছে জঙ্গলের জায়গায় বসবাসকারী এমন পরিবারগুলিকে উচ্ছেদ করতে হবে।
প্রথমবার কেন্দ্রীয় সরকার তেমন কোনও আপত্তি না তোলায়, আদলত পশ্চিমবঙ্গ সহ ২১টি রাজ্যকে নির্দেশ দেয়— জঙ্গলে বসবাসকারী যে ১১.৮ লক্ষ মানুষের জমির অধিকার খারিজ হয়েছে, তাদের সরিয়ে নিতে হবে। পাট্টাহীন ভাবে বন দফতরের জমিতে বসবাস করছেন তেমন পরিবারগুলির আতঙ্কের সূত্রপাত সেখান থেকেই। একই সমস্যা ছিল বীরভূমও। প্রথমবার আপত্তি না তুললেও সুপ্রিম কোর্ট ওই নির্দেশ দেওয়ার পরেই কেন্দ্র তা সংশোধনের আর্জি জানিয়ে বলে, ‘সিডিউলড ট্রাইব অ্যান্ড আদার ট্র্যাডিশলান ফরেস্ট ডুয়েলার্স (রেকগনিশন অব ফরেস্ট রাইটস) অ্যাক্ট, ২০০৫’-অনুসারে তাঁদের জমির অধিকারের কথা অনেক ‘চরম দরিদ্র ও নিরক্ষর’ বনবাসী জানেন না। এই নির্দেশ তাঁরা বঞ্চিত ও উচ্ছেদ হবেন। মামলাটি গ্রহণ করেছে বেঞ্চ। ২৪ তারিখ তার রায় ঘোষণার কথা।
রবীন বলছেন, ‘‘সোনভদ্রে যা ঘটেছে তা সভ্য সমাজের লজ্জা। অভিযুক্তদের কঠোর শাস্তি চাই। অন্য দিকে, ২৪ তারিখে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায় যদি বিপক্ষে যায় তা হলে জঙ্গল ঘেঁষে বসবাস করা এত এত প্রান্তিক ও নিরক্ষর আদিবাসী কোথায় যাবেন। সেই জন্যই আদিবাসী সংগঠনগুলির পক্ষে থেকে এই
কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। বীরভূমের আদিবাসী সংগঠনের আরও দাবি, বীরভূমে কয়লা খনি গড়ার জন্য জঙ্গল কেটে আদিবাসীদের জীবন-জীবিকার উপরে কোপ বা আদিবাসী পরিবারকে ভিটেছাড়া করার বিরুদ্ধেও এই প্রতিবাদ।