বিজয়ের জয়ের রথ অব্যাহত থাকবে, নাকি এ বার ‘রথের রশি’ টেনে ধরবেন নরেশচন্দ্র বাউরি? নাকি তৃতীয় কেউ?
— সে উত্তর পেতে অপেক্ষা করতে হবে ১৯ মে পর্যন্ত। তাই বলে নানা জল্পনা, আঁক কষা, চাপান-উতোর কি থেমে থাকে? ভোটের দুবরাজপুরে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে কে হারবে, কে জিতবে তা নিয়ে নানা জল্পনা, হরেক ব্যাখ্যা। তুফান উঠছে চায়ের পেয়ালায়!
এমনিতে গত বিধানসভা ভোটে তৃণমূলের দাপট সত্বেও বীরভূমের যে আসনগুলিতে বামেরা জিতেছিল দুবরাজপুর তার অন্যতম। জিতেছিলেন টানা পাঁচ বারের বিধায়ক ফব-র বিজয় বাগদি। এ বারও সেই বিজয় বাম-কংগ্রেসের ‘অনুচ্চারিত জোটের’ প্রার্থী। যিনি ছ’বার পেরেছেন, তিনি সপ্তমবারও সুনাম ধরে রাখেতে পারবেন?
বাম শিবিরের ব্যাখ্যা, তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, বোমাবাজি-হানাহানিতে গোটা বীরভূম তো বটেই বিতশ্রদ্ধ দুবরাজপুরবাসীও। এই বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে থাকা খয়রাশোলে ২০১১ সালের পর থেকে খুন হয়েছেন ছ’জন। বোমাবাজি ও বিস্ফোরণে মৃত্যুর সংখ্যা পাঁচের বেশি। এখন মানুষ শান্তি চান। নিজেদের মত প্রকাশের সুযোগ পেলে এগিয়ে তারাই। তৃণমূল নেতারাও আশাবাদী এ বার ইতিহাসের বদল হতে চলছে। জিতছেন তাদের প্রার্থী নরেশচন্দ্র বাউড়ি।
এলাকায় জনমতের একটা বড় অংশ বলছে, এই মুহূর্তে জোট-প্রার্থী এগিয়ে। তবে একটা কিন্তু রয়েছে। সেটা ‘বিজেপি ফ্যাক্টর’ এবং ‘তৃণমূলের কোন্দল’। যাঁরা সংগঠনগত ভাবে এই মুহূর্তে তলানিতে, সেই বিজেপিকে নিয়ে ভয় কোথায়? রাজনীতির কারবারিরা বলছেন, ‘‘না থাকুক সংগঠন। দুবরাজপুরে জেতা-হারায় ব্যবধান গড়ে দিতে পারে বিজেপি।’’ তাঁদের মত, এখনও খয়রাশোলের লোকপুর, বাবুইজোড়, হজরতপুর-সহ বিভিন্ন পঞ্চায়েত এলাকায় ভাল রয়েছে বিজেপি-র। সেই ভোটের অংশ কোন দল, কতটা পরিমাণ নিজেদের দিকে টানতে পারে — জেতা হারায় সেটা নির্ণায়ক হবে।
অনেকেই বলছেন, তৃণমূল নেতৃত্ব মুখে যতই বলুন এলাকায় কোন্দল নেই বাস্তব পরিস্থিতি তেমনটা নয়। তৃণমূল অন্দরের খবর, খয়রাশোল পঞ্চায়েত সমিতি এলাকার পঞ্চায়েতগুলিতে ক্ষমতায় থাকালেও দলের মধ্যে কোন্দোল লেগেই আছে। দুবরাজপুর পুর এলাকা শাসকদলের দখলে থাকলেও সেখানেও বিরোধের চোরাস্রোত রয়েছে। ভোটের একেবারে মুখে সেটা কতটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন সেটার উপরেও অনেক কিছু নির্ভর করছে।
দুবরাজপুর বিধানসভার মধ্যে রয়েছে খয়রাশোল ব্লক (১০টি পঞ্চায়েত নিয়ে ব্লক), দুবরাজপুর পুরসভা এবং দুবরাজপুরে ৬টি পঞ্চায়েত এলাকা। ভোটার সংখ্যা এই মুহূর্তে ২ লক্ষ ১৫ হাজার ৫৭৫ জন। ২০১১ সালের নির্বাচনের আগে পর্যন্ত খয়রাশোল ব্লকটি ছিল রাজনগর বিধানসভার অন্তর্গত। অন্য দিকে, দুবরাজপুর বিধানসভা আসনের মধ্যে ছিল ইলামবাজার ব্লকটি। পুনর্বিন্যাসের পরে রাজনগর বিধানসভা আসনটির অবলুপ্তি ঘটিয়ে খয়রাশোল ব্লক দুবরাজপুর বিধানসভা আসনে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। বাদ পড়ে ইলামবাজার ব্লক।
পরপর পাঁচবার বামফ্রন্টের শরিক দল ফব-র প্রার্থী বিজয় বাগদি রাজনগর বিধানসভা থেকে জিতেছেন। ২০১১ সালে দুবরাজপুর বিধানসভায় বামেদের প্রার্থী হন তিনি। সে বার কংগ্রেস ও তৃণমূলের জোট প্রার্থী সন্তোষী সাহার সঙ্গে প্রবল লড়াইয়ের পরে ২৭১৩ ভোটে জেতেন বিজয়। খয়রাশোল এলাকায় বহু দিন থেকেই কংগ্রেসের একটা শক্তি ছিল। ২০০৯ এর লোকসভা নির্বাচনের আগে খয়রাশোল ব্লকের কংগ্রেস থেকে তৃণমূলে চলে এলেও শেষ রক্ষা হয়নি। রাজনীতির বিশ্লেষকদের মতে, দীর্ঘ দিন ধরে খয়রাশোল এলাকায় একমুখ দেখতে দেখতে বামপ্রার্থী থেকে সরে এসে তৃণমূলে ভোট দিয়েছিলেন ঠিকই। কিন্তু তীরে এসে তরি ডোবার জন্য তৃণমূলের দ্বন্দ্বকেই দায়ী করেছিলেন তৃণমূল প্রার্থী সন্তোষী।
সেই শুরু। সময় যত গড়িয়েছে খয়রাশোলে তৃণমূলের (অশোক ঘোষ ও অশোক মুখোপাধ্যায়) গোষ্ঠী কোন্দল প্রবল থেকে প্রবলতর হয়েছে। ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে খয়রাশোল বাদে পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতির সিংহ ভাগ আসনে শাসকদল ক্ষমতায় এলেও বিবাদ মেটেনি। বিরোধের পিছনে কয়লা সাম্রাজ্যের কর্তৃত্ব, বিবাদমান দুই গোষ্ঠীর নেতা খুন হলেও অশান্তি যেন কিছুতেই খয়রাশোলের পিছু ছাড়েনি। লোকসভা নির্বাচনে তার প্রভাব পড়েছিল। ভোট প্রাপ্তিতে কোপ পড়েছিল দুবরাজপুরেও। গত লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল প্রার্থী শতাব্দী রায় দুবরাজপুর বিধানসভা এলাকায় থেকে ৬০,৮৩৪ ভোট পেয়েছিলেন। বামেদের ভোট ছিল ৫২, ৯৪১টি। ঠিক পিছনেই ছিল বিজেপি-র প্রাপ্ত ভোট, ৪৪,৫১৪। শতাংশের হিসাবে যা ২৪.৯৫।
বামেদের যুক্তি, এক সময় শাসকদলের অত্যাচারে কিছু মানুষ বিজেপিতে ঝুঁকে ছিলেন। তার মধ্যে বামপন্থী মনোভাবাপন্ন যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের মনে হয়েছিল বাম দল তাঁদের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ। বর্তমানে রাজ্য ও কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দুই সরকারের কাজ নিয়েই অসন্তোষ রয়েছে এই অংশের। নিজের এলাকায় অশান্তির পরিবেশে মোহভঙ্গ হয়েছে তাঁদের। যাঁরা বিজেপিকে ভোট দিয়েছিলেন, তাঁদের অনেকেই এখন জোট প্রার্থীর দিকে ঘুরে গিয়েছেন বলে মনে করছেন অনেকেই। তৃণমূল নেতাদের আবার দাবি, লোকসভা ভোটের সময়ে ‘মোদী হাওয়ায়’ ভর করে ফাঁক তালে কিছু ভোট পেয়েছিল বিজেপি। যা এ বার তাদের দিকেই ফিরবে।
একই সঙ্গে তৃণমূল নেতৃত্ব মনে করেন, বিজয় বাগদি দীর্ঘ দিন বিধায়ক থাকলেও তাঁর কাজ মানুষ দেখতেই পাননি। সেই কারণেই নরেশচন্দ্রকে মানুষ ভোট দেবেন। নরেশ নিজে দাবি করেছেন, ‘‘এখন এলাকায় এলাকায় যে পরিমাণ উন্নয়ন হয়েছে, শুধু তার ভিত্তিতেই মানুষ আমাদের ভোট দেবেন।’’ বাম শিবিরের পাল্টা দাবি, কে বলল বিধায়ক উন্নয়ন করেননি? বিধায়কদের হাতে তো সরাসরি উন্নয়ন করার ক্ষমতা থাকে না। বছরে পাওয়া ৬০ লক্ষ টাকা পঞ্চায়েতের মাধ্যমে খরচ করতে হয়। পঞ্চায়েতে টাকা পয়সার ভাগ বাটোয়ারা নিয়েই তো কোন্দোল! তারপরেও বিধায়ক তহবিলের টাকায় অনেক উন্নতি হয়েছে, মত বাম শিবিরের।
তবে ফারাক গড়ে দিতে পারেন স্থানীয় প্রার্থী বিজয়। হাতের নাগালেই তাঁকে পাওয়া যায়। বিজয় নিজে বলছেন, ‘‘হাতের তেলোর মতো এলাকা চেনা। তৃণমূলের হুমকির জন্য কিছুটা হলেও নিজেকে গুটিয়ে রাখতে হয়েছিল। এ বার মাঠে নেমে পড়েছি।’’ নিজেকে ভূমিপুত্র বলে দাবি করছেন বোলপুর পুরসভার উপপুরপ্রধান নরেশও। শেষ লড়াই জিতবেন তিনিই, বলছেন আত্মবিশ্বাসী নরেশ।