খেলার ছলে পড়ার আসর রাধানগর স্কুলে। নিজস্ব চিত্র।
অতিমারীর জেরে স্কুল বন্ধ। দীর্ঘদিন স্কুলের মুখে দেখেনি প্রাথমিকের পড়ুয়ারা। কেউ কেউ অনলাইন ক্লাস করলেও নতুন ওই মাধ্যম রপ্ত হয়নি অনেকেরই । সুযোগও মেলেনি অনেকের। পড়াশোনা। এই পরিস্থিতিতে গ্রামের প্রাথমিক পড়ুয়াদের কাছে ‘খেলতে খেলতে লেখাপড়া, পড়তে পড়তে খেলা’ যেন এক সব পেয়েছির আসর । সৌজন্য, বাঁকুড়ার রাধানগর বোর্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকারা।
স্কুলের পাঠ্য বইয়ের বিষয় কি শুধু মুখস্তের জন্য? নম্বর তোলার ইঁদুর দৌড়ে কিছু বুঝে, কিছু না বুঝে শুধু মুখ গুঁজে পড়ে যাওয়া? প্রাথমিকের পড়ুয়াদের পড়াতে পড়াতে একসময় রাধানাগর বোর্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সৌম্য সেনগুপ্ত বুঝতে পারেন শিশুদের মাথায় তথ্যের বোঝা বাড়লেও বিষয় বুঝে বাস্তব জীবনে তার প্রয়োগের ক্ষেত্রে ফাঁক থেকে যাচ্ছে। পড়া বোঝানোর জন্য হাতেকলমে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা বেশি । কিন্তু অতিমারীতে স্কুলই তো বন্ধ । পড়ুয়ারা শিখবে কোথায়? অগত্যা বছর দেড়েক আগে সৌম্যর উদ্যোগে একটি ইউ টিউব চ্যানেল তৈরি করে ফেলেন রাধানগর বোর্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষিকারা । দিনরাত পরিশ্রম করে ভিডিয়ো তৈরি করতে শুরু করেন তাঁরা ।
পাঠ্য বইয়ের বিষয়গুলিকে অনুসরণ করে সেগুলিকে হাতে কলমে বুঝিয়ে দেওয়া ও তার প্রয়োগবিধি সংক্রান্ত ভিডিয়ো তৈরি করে তা সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে থাকেন শিক্ষক-শিক্ষিকারা । আলোর মুখে বিভিন্ন আকারের বল রেখে চন্দ্রগ্রহণ ও সুর্যগ্রহণের বিজ্ঞান থেকে শুরু করে কাগজের টুকরো নিয়ে লসাগু, নুড়ি পাথর দিয়ে গসাগু শেখার ভিডিয়ো তৈরি করেন তাঁরা।
পড়ুয়াদের মানসিক বিকাশের উদ্দেশ্যে পাঠ্য বইয়ের পড়া ছাড়াও শেখানো শুরু হয় ছবি আঁকা, আবৃত্তি, কাঁচা মাটির তাল দিয়ে মূর্তি গড়া, গান শেখানো। সাপে কামড় দিলে প্রাথমিক করণীয় থেকে শুরু করে শিশুর শ্বাসনালীতে খাবারের টুকরো আটকে গেলে কী করা দরকার সে সবই হাতেকলমে দেখিয়ে ভিডিয়ো তৈরি করা হয় । অল্প সময়ের মধ্যেই পড়ুয়াদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সেগুলি। পড়ুয়াদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেন সাপের কামড়ের চিকিৎসার ক্ষেত্রে এ রাজ্যের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দয়ালবন্ধু মজুমদার থেকে শুরু করে জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের কর্মী চিকিৎসক পুণ্যব্রত গুণ, পাঁচমুড়ার টেরাকোটা শিল্পী ভূতনাথ কুম্ভকার থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান মল্লিকা বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের বিশিষ্টজনেরা।
শিক্ষক সৌম্য বলেন, “আমাদের স্কুলের সিলেবাসে যে বিষয়গুলি রয়েছে তা প্রতিটি শিশুর কাছে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও মনোবিজ্ঞানের দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । কিন্তু সব ক্ষেত্রে আমরা তার প্রাসঙ্গিকতা ও প্রয়োগবিধি পড়ুয়াদের শেখাতে পারি না । খেলার ছলে পড়ুয়াদের সেই শূন্যস্থান পূরণ করার উদ্দেশ্যেই আমাদের এই উদ্যোগ।’’
তিনি জানান, রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের কয়েক হাজার পড়ুয়া আমাদের এই ভিডিও গুলি নিয়মিত আগ্রহের সঙ্গে দেখছে । আমাদের এই উদ্যোগে সামিল হয়ে তাঁদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন বহু মানুষ। আমরা চাই আগামীদিনে আমাদের এই ভিডিয়োগুলি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ুক গ্রাম থেকে গ্রামান্তরের পড়ুয়াদের কাছে।’’
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান মল্লিকা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “সৌম্য ও তাঁর স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা যেভাবে অঙ্ক থেকে বিজ্ঞান, নাচ গান থেকে আবৃত্তির সহ সমস্ত বিষয়ের খুঁটিনাটি অত্যন্ত সহজ, সাবলিল ভাবে ভিডিয়োগুলিতে তুলে ধরেন তাতে আমি মুগ্ধ। আমি ভাবতেই পারি না এত সহজ ও আকর্ষণীয় ভাবে কোনো বিষয়কে পড়ুয়াদের কাছে উপস্থাপন করা যেতে পারে । বাঁকুড়ার রাধানগরের প্রত্যন্ত গ্রামে বসে সামান্য পরিকাঠামোয় তাঁরা যা করে দেখিয়েছেন তা নিঃসন্দেহে অন্যদের কাছে দৃষ্টান্ত।’’