অঙ্কন: কুনাল বর্মণ
নিয়ম মেনে সূর্য উঠেছে, অস্ত গিয়েছে। ঋতু বদলেছে। অথচ আমি কিছুই দেখিনি, অনুভব করিনি। টানা এক বছর আকাশটাই দেখিনি আমি! আমার আকাশ দেখার অধিকার ছিল না। ছোট্ট মেয়েকে ইচ্ছেমতো কোলে নেওয়া অধিকারটুকুও ছিল না আমার। আরও কত অধিকার ছিল না, সে হিসেব কষতে বসলে শেষ হবে না। স্বামীর মৃত্যুর পরে দুর্বিষহ সেই একটা বছর আমৃত্যু ভুলতে পারব না।
আমার এই কাহিনি শুনলে মনে হতে পারে চিত্রনাট্য। কিন্তু, এই প্রত্যেকটা ঘটনা আমার জীবনের অভিজ্ঞতা। যা আজও আমাকে পিছু টানে। রাতে ঘুমের সময় মাঝেসাঝে জাগিয়ে দেয় এখনও।
সালটা ১৯৮৭। সিউড়ি থেকে কলকাতায় আহিরীটোলায় বিয়ে হয়েছিল আমার। খুব ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়ে নিত্য লড়াইয়ে ছেদ টেনে যেন একটু থিতু হওয়া। স্বামীর গেঞ্জি তৈরির ব্যবসা ছিল। যৌথ পরিবার। চার ননদ, দুই দেওর, শাশুড়ি—সব মিলিয়ে বেশ জমজমাট পরিবারের বড় বউ আমি। সব ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু, জীবন কি যেমন ভাবি, তেমন যায়? যায় না। বরং জীবন খুব বড় বড় পরীক্ষা নেয়। আমার জন্যও তেমনই এক বড় পরীক্ষা তুলে রাখা ছিল। সব কিছু কেমন ওলোটপালট হয়ে গেল ’৯০ সালে। হঠাৎ স্ট্রোকে আমার স্বামী চলে গেলেন। আমার মেয়ের বয়স তখন মাত্র পাঁচ মাস। চোখে অন্ধকার দেখছি। কী করব বুঝতে পারছি না। ওইটুকু শিশুকে নিয়ে কী ভাবে জীবন চালাব, জানি না। ওই অবস্থায় শ্বশুরবাড়ি থেকে দাদাদের পরিবারে ফিরে এসে তাঁদের বোঝা হতে চাইনি। সেই সুযোগও ছিল না।
কিন্তু, তখনও জানতাম না, আরও কঠিন ও রূঢ় পরীক্ষা আমার জন্য অপেক্ষায় আছে। আশপাশের চেনা চরিত্রগুলো হঠাৎ করেই কেমন যেন বদলে গেল। অনেক কিছু ঘটতে লাগল, যার সবটা এখানে বলা সম্ভব নয়। কিন্তু, সেই সময় কাউকে আমার অবস্থার কথা বলার বলার উপায়ও ছিল না। কারণ, বাইরে বের হতে দেওয়া হত না আমাকে। টানা এক বছর এ ভাবে থাকতে থাকতে হাঁফিয়ে উঠেছিলাম। এক-এক সময় মনে হত, নিজেকে শেষ করে দিই। কিন্তু, দুধের মেয়েটার মুখ মনে পড়ে যেত! ওই-ই একমাত্র তখন আমার ভরসাস্থল। ওর মুখের দিয়ে তাকিয়েই নিজেকে বলতাম, যে-ভাবেই হোক মুক্তি পেতে হবে এই দুর্বিষহ জীবন থেকে।
রান্নাঘরের জানালা খোলা থাকলে পড়শিদের কেউ কেউ ইশারায় বলতেন, বাঁচতে চাইলে এখানে থাকে চলে যাও। কিন্তু কী ভাবে পালাব, পথ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। কিন্তু, ওই যে সব সুড়ঙ্গের শেষেই একটা আলোর রেখা থাকে! আমার জীবনেও তেমনটা ঘটল। আমাদের পাড়াতেই বিয়ে হয়েছিল সিউড়ির বাসিন্দা এক দিদির। তাঁকে এক দিন দেখতে পেয়ে কাগজে আমার পরিস্থিতির কথা লিখে দোতলার জানালা দিয়ে রাস্তায় ফেলেছিলাম। দিদি সেই কাগজের টুকরো পড়ে আমার কথা পৌঁছে দেন, সিউড়ি শহরের বারুইপাড়ায়, বাপের বাড়িতে। ১৯৯১-এ কলকাতায় আমার শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে দাদারা আমাকে আর মেয়েকে সিউড়িতে নিয়ে আসেন।
ফিরে তো এলাম, কিন্তু দাদাদের বোঝা হয়ে থাকব কী করে, এই প্রশ্নটাই বড় করে দেখা দিল। তিন দাদা তাঁদের প্রত্যেকের সংসার আছে। বাপের বাড়িতে আমার বলতে কিছুই নেই। বাবা কোন ছোট বেলায় মারা গিয়েছেন। আমার দুঃখ দেখে মা-ও মারা গেলেন। যে-ভাবে ছোট থেকে গৃহশিক্ষকতা করে লেখাপড়া করেছি, স্নাতক হয়েছিলাম বিয়ের আগে, সেই লড়াই আবার শুরু করলাম। দিনভর টিউশন, সেলাইয়ের কাজ করে কোনও রকম চলছিল। পাশাপাশি একটা কাজ খুঁজছিলাম, যাতে মা-মেয়ের চলে যায়। বিভিন্ন সরকারি দফতরে ঘুরছিলাম।
এ ভাবে কেটে গেল দু’বছর। হতাশ হলেও হতদ্যোম হয়ে পড়িনি। কারণ, কাজটা বড় দরকার ছিল। ’৯৩ সালে সালে একটা সুযোগ এসে যায়। সেই সময় নির্যাতিত, অবহেলিত ও সহায়সম্বলহীন আঠারো ঊর্ধ্ব মেয়েদের রাখার জন্য সিউড়িতে সরকার পোষিত একটি হোম খোলার নির্দেশ আসে সমাজ কল্যাণ দফতর থেকে। মাসিক ৪০০ টাকা মাইনেতে আবাসিকদের দেখভালের দায়িত্বে সুযোগ পাই আমি। সবচেয়ে বড় কথা, শিশুকন্যা নিয়ে একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই জোটে। এ ছিল এক অন্য লড়াই। এক দিকে নিজের মেয়েকে বড় করার দায়িত্ব, অন্য দিকে হোমের মেয়েদের দেখভাল।
সেই থেকে আজ পর্যন্ত একই কাজে ব্রতী। সিউড়ির সরকার পোষিত হোমের সুপার পদে এখন আমি। কত সমস্যা নিয়ে মেয়েরা এখানে আসে। পরিস্থিতি শুধরে ফের বাড়ি ফেরে। কেউ কেউ প্রশিক্ষণ নিয়ে স্বাবলম্বী হয়ে সমাজের মূল স্রোতে ফিরে যায়। ওদের প্রত্যেকের সঙ্গে কোথাও আমার জীবনকাহিনির মিল খুঁজে পাই। চেষ্টা করি তাঁদের সান্ত্বনা দিতে। পাশে থাকতে। সাধ্যমতো নিজের দায়িত্ব পালন করতে। আরও কয়েক জন রয়েছেন হোমে, যাঁরা আমায় সাহায্য করেন। এটা একটা গোটা পরিবারের মতো। তবে, এ পরিবারে সুখ আছে, শান্তি আছে। আমি গৃহকর্ত্রী। সকলের খবর নেওয়া, ওষুধ খাওয়ানো, বাজার করা, খাবারের বন্দোবস্ত থেকে এক সঙ্গে বসে টিভি দেখা— দিনভর এই আমার কাজ। আবাসিকেরা বদলে যান, নতুন আবাসিক আসেন। কিন্তু, সাত দিন চব্বিশ ঘন্টা আমার কাজ, রুটিন বদলায় না।
তবু অনেক ভাল আছি। এই হোম আমাকে দিয়েছে অনেক কিছু। সবচেয়ে বড় কথা, এই হোম থেকেই আমি আমার মেয়েকে মানুষ করেছি। এমএসডব্লিউ পড়িয়েছি। সে এখন সিউড়ি সরকারি হাসপাতালের ব্ল্যাড ব্যাঙ্কে কাজ করে। সংসারও হয়েছে। জামাই ব্যবসা করে। শান্তি পাই মনে মনে। এই হোম থেকে যে-সব আবাসিক মেয়ে পড়াশোনা করে কেউ পুলিশের চাকরি পেয়েছে, নার্সিংয়ে গিয়েছে, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী হয়েছে বা সমাজের মূল স্ত্রোতে ফিরে গিয়েছে— তারা যখন শিকড়ের টানে এখানে আসে, আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখে, তখন খুব ভাল লাগে। আমার কাজ যেন স্বীকৃতি পায়, পূর্ণতা পায়। ওরা আমাকে মনে রেখেছে, এই অনুভবটাই মনে খুশি ডেকে আনে।
যতদিন কর্মক্ষম থাকব, আমার এই দায়িত্ব থেকে যেন আমায় সরিয়ে না দেওয়া হয়—এটাই আমার একমাত্র প্রার্থনা। জীবনভর যে লড়াই করেছি, প্রৌঢ়ত্বের থেকে ধীরে ধীরে বার্ধক্যের দিকে পা বাড়ানো আমার পক্ষে আর নতুন করে কিছু করা সম্ভব নয়। তা ছাড়া, এই মেয়েরাই এখন আমার জীবন। ওদের জন্যই আমি, আমার জন্য ওরা।
আর জীবনে কিছু চাই না।
লেখক ‘আশা স্বধার হোম’-এর (সরকার পোষিত) সুপার
অনুলিখন: দয়াল সেনগুপ্ত