এই সেই বার্তা। নিজস্ব চিত্র
জানুয়ারির প্রথম রবিবার। এমন ছুটির দিনে ময়ূরাক্ষী নদী-ঘেঁষে সিউড়ি তসরকাটায় বসেছিল একাধিক পিকনিকের আসর। সেখানে দুটি গাছে বাঁধা একটি পোস্টার আলাদা ভাবে নজর কাড়ল। তাতে লেখা, ‘মাঠে পাঠান, মোবাইল ছাড়ান’।
আবেদনের প্রকৃত লক্ষ্য যে মোবাইল, ট্যাব, ল্যাপটপে বুঁদ বর্তমান প্রজন্ম, সেটা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু, যেখানে জেলার বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন পিকনিকের আসরে ডিজে বক্সের সঙ্গে দেদার নাচ, কোথাও কোথাও প্রকাশ্য মদের আসরই চেনা ছবি, সেখানে পিকনিকের আসরে এমন বার্তা নজর কাড়ে বইকি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেল পিকনিকের ওই আসর বসিয়েছিলেন শহরের চার ক্রীড়াপ্রেমী। সেই দলে স্বরাজ মণ্ডল, মনোজিত মিত্র, শৈলেন দাসের মতো যুবকদের সঙ্গে ছিলেন রফি আহমেদের মতো প্রৌঢ়ও। যাঁরা প্রত্যেকে নিজের নিজের কাজ সামলেও প্রত্যেকে ফুটবল কোচিং ক্যাম্প চালান। শেখে ৩০ জন পড়ুয়া। তাদের সকলকে নিয়ে পিকনিক করতে এসে সমাজের কাছে এই আবেদনই রাখলেন ওঁরা। তাঁদের কথায়, ‘‘আমাদের কারও ব্যবসা আছে। কেউ জীবনবিমার এজেন্ট, কেউ শরীরশিক্ষা নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। কিন্তু, সকলেই খেলা ভালবাসি। চুটিয়ে খেলেছি। আর, পোস্টার দেওয়ার উদ্দেশ্য একটাই, আমাদের কাছে বাচ্চাদের শেখানোর জন্য অনুরোধ নয়। বাবা-মায়েরা যেন তাঁদের ছেলেমেয়েদের খেলতে পাঠান। উদ্দেশ্য সেটাই।’’
আশেপাশে যাঁরা পিকনিক করছিলেন, তাঁদের অনেককেই আকৃষ্ট করেছে পোস্টার। এমন ভাবনার প্রশংসা করেছেন সিউড়ি হাসপাতালের চিকিৎসক শৈবাল মজুমদার। তিনি বলছেন, ‘‘শহরের কেউ এমন ভেবে থাকলে সত্যিই সেটা দারুণ ব্যাপার। কখনও নিজেদের সময়ের অভাব, কখনও ভয়ে বেশির ভাগ বাবা–মা তাঁদের ছেলেমেয়েকে খেলতে দেন না। তার বদলে মোবাইল, ট্যাব, ল্যাপটপ গুঁজে দেন। এতে যে কত বড় ক্ষতি হচ্ছে বলার নয়।’’ শৈবালবাবুর সংযোজন, ‘‘খেলার মাঠে গেলে শারীরিক পরিশ্রমের পাশাপাশি একসঙ্গে চলার মানসিকতা, পারস্পরিক বোঝাপড়া, অন্যের সঙ্গে সহজে মেশার মতো অভ্যাস গড়ে ওঠে।’’
একই মত মনোবিজ্ঞানীদের। তাঁদের কথায়, ‘‘যে বয়স শিশুকে মানসিক ভাবে সুস্থ, সুন্দর ও বড় করে তুলতে সাহায্য করে, সেই সময়েই থাবা বসায় স্মার্টফোন। ফোনে ডুবে থাকলে বাচ্চার মানসিক সমস্যাও দেখা যেতে পারে। সৌজন্যবোধ হারিয়ে যেতে পারে। যারা সেলফি তোলায় মগ্ন থাকে, তাদের অনেকের মধ্যেই আত্মকেন্দ্রিকতার লক্ষণ প্রকাশ পায়।’’ চিকিৎসক ও সমাজ বিজ্ঞানীদের অনেকে মনে করছেন, বাচ্চাদের স্মার্টফোন প্রীতির মূল কারণ নিউক্লিয়ার পরিবার এবং একক সন্তান। ইন্ডোর গেমে অনেকে আপত্তি না করলেও ‘বডি কন্টাক্ট গেম’ যেমন ফুটবল ক্রিকেট, কবাডি বা অন্য দলগত খেলায় সন্তানকে ছাড়তে রাজি হন না বাবা-মায়েরা। ছোট পরিবার হওয়ায় বাবা-মা উভয়েই কাজ ব্যস্ত থাকেন। তাতেও উপেক্ষিত থাকে শিশুরা।
এ সবে রাশ টানার সময় এখনই। এই নিয়ে নানা মাধ্যমে প্রচারও চলছে। সেটাই উসকে দিল পিকনিকের ওই পোস্টার।