শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। —নিজস্ব চিত্র।
প্রায় তিন দশক ধরে মল্লগড় বিষ্ণুপুরে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন ‘কত্তাবাবু’। পোশাকি নাম শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। তবে বিষ্ণুপুরের আম জনতার কাছে তিনি ‘কত্তাবাবু’ নামেই পরিচিত। হবেন না-ই বা কেন? গত তিন দশকের বেশি বিষ্ণুপুর পুরসভায় চেয়ারম্যান শ্যামাপ্রসাদ হয়ে উঠেছিলেন বিষ্ণুপুরের হর্তাকর্তা-বিধাতা! তবে একাধিক সরকারি প্রকল্পে আর্থিক বেনিয়মের অভিযোগে রবিবার তাঁকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। বিষ্ণুপুর জুড়ে এখন একটাই প্রশ্ন— মল্লগড়ের মুকুটহীন সম্রাট ‘কত্তাবাবু’ এ বার কী হবে?
রাজনৈতিক যাত্রা শুরু ১৯৮৬-তে। সে বছর বিষ্ণুপুর পুরসভার কাউন্সিলর হয়েছিলেন তরুণ শ্যামাপ্রসাদ। ১৯৯০ সালে বামেদের ভরা বাজারেও কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটি হিসাবে পরিচিত বিষ্ণুপুরের পুরপ্রধান হন তিনি। এর পর ধীরে ধীরে পুরসভার সর্বেসর্বা হয়ে ওঠেন। স্থানীয়েরা তাঁকে ‘কত্তাবাবু’ বলে ডাকতে শুরু করেন। অপ্রতিদ্বন্দ্বী শ্যামাপ্রসাদের মুখের কথাই ছিল বিষ্ণুপুর পুরসভার অলিখিত আইন। অভিযোগ, ‘কর্তার ইচ্ছাই কর্ম’ নীতিতেই তিন দশক ধরে চলেছেন কাউন্সিলর-পুরকর্মীরা। পুরসভার অন্দরমহলের কানাঘুষো— বিষ্ণুপুরের উন্নয়নমূলক প্রকল্প রূপায়ণের ক্ষেত্রে টেন্ডারের ধারেকাছে যেতেন না শ্যামাপ্রসাদ। পছন্দের ঠিকাদারকে ডেকে মুখে মুখে কাজের বরাত দিতেন। কাজ শেষ হলে সময় মতো টেন্ডার করে ঠিকাদারকে কাজের টাকা পাইয়ে দিতেন। তবে তাঁদের একাংশের দাবি, কাজ শেষের টাকা পেতে পুরসভায় তদ্বির করতে করতে জুতোর সুকতলা ক্ষয়ে যেত। ‘কত্তাবাবু’র কোপে পড়ার ভয়ে কেউ টুঁ শব্দটি করতেন না। শহরবাসীর একাংশের অভিযোগ, নিজের পছন্দের লোকদের কাউন্সিলর হিসাবে ভোটে জিতিয়ে এনে বিষ্ণুপুর পুরসভায় মৌরসি পাট্টা চালাতেন তিনি।
২০০৯ সালে কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেন শ্যামাপ্রসাদ। সেই সময় বিষ্ণুপুর পুরসভার প্রায় সব কাউন্সিলরই তাঁর মতো জোড়াফুল পতাকা হাতে তুলে নেন। ২০১১ সালে বিষ্ণুপুর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে জয়ী হয়ে রাজ্যের আবাসনমন্ত্রী হলে শ্যামাপ্রসাদের ক্ষমতা আরও বাড়ে। সে সময় কিছু দিনের জন্য জেলা সভাপতির দায়িত্বও পান। ২০১৬ পর্যন্ত নারী ও শিশু কল্যাণ দফতর, কখনও বা বস্ত্রমন্ত্রীর দায়িত্বও সামলান শ্যামাপ্রসাদ।
মন্ত্রী থাকাকালীনই চিটফান্ড কেলেঙ্কারিতে শ্যামাপ্রসাদকে নোটিস দেয় ইডি। এর পর থেকেই তাঁর জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়তে শুরু করে। ২০১৬-র বিধানসভা ভোটে তৃণমূলের টিকিটে পরাজিতও হন। এটাই তাঁর অপরাজেয় ভাবমূর্তিতে প্রভাব ফেলে। ধীরে ধীরে ‘কত্তাবাবু’র বিরুদ্ধে আওয়াজ উঠতে শুরু করে বিষ্ণুপুরেও। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের সময় বিষ্ণুপুরে প্রভাব বাড়তে থাকে বিজেপি-র। জোড়া ফলায় চাপে বেসামাল হয়ে পড়ে ‘কত্তাবাবু’র প্রভাব। গত বছর বিষ্ণুপুর পুরসভার মেয়াদ শেষ হলে শ্যামাপ্রসাদকে প্রশাসক হিসাবে নিয়োগ করে রাজ্য সরকার। কিন্তু গত নভেম্বরে তাঁকে পুরপ্রশাসক পদ থেকে সরানো হলে বিজেপি-তে যোগ দেন তিনি।
বিজেপি-র অন্দরেও দলের একাংশের বিরোধিতার মুখে পড়ে কোণঠাসা হয়ে পড়েন শ্যামাপ্রসাদ। তৃণমূলে ফিরে পিঠ বাঁচানোর চেষ্টাও ব্যর্থ হয়।
রবিবার তাঁর গ্রেফতারির পর শ্যামাপ্রসাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়েই প্রশ্ন উঠে গিয়েছে বিষ্ণুপুরে। শহরের অধিকাংশেরই দাবি, দীর্ঘদিন ধরে নিয়মবিরুদ্ধ ভাবে পুরসভা চালাতে গিয়ে দুর্নীতির পাহাড় গড়েছেন কত্তাবাবু!