গাছের গুঁড়ি ফেলে পথ অবরোধ। পুরুলিয়ার বোরোর বুরুডি মোড়ে। নিজস্ব চিত্র।
সারি ধরম কোডের স্বীকৃতির দাবিতে রবিবার কলকাতায় রানি রাসমনি রোডে মহা সম্মেলন ডাকা হয়েছিল। জেলা থেকে সেখানে লোক নিয়ে যেতে পরিবহণ দফতরের কাছে গাড়ি ভাড়া করেও পর্যাপ্ত সংখ্যায় তা না দেওয়ার অভিযোগ তুলে দুই জেলায় অবরোধে বসলেন ভারত জাকাত মাঝি পারগানা মহলের নেতা-কর্মীরা। কোথাও কোথাও যোগ দেন সহযোগী কিছু সংগঠনের কর্মীরাও। এর জেরে এ দিন সকাল প্রায় ৬টা থেকে দুই জেলার মূলত দক্ষিণ অংশের জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। সন্ধ্যার মুখে বাঁকুড়া জেলার অনেক জায়গায় অবরোধ উঠলেও, পুরুলিয়ায় রাত ন’টা পর্যন্ত অবরোধ ওঠেনি।
অবরোধে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থেকে যাত্রীরা খিদে-তৃষ্ণায় নাজেহাল হন বলে অভিযোগ। রাতে এসডিও (মানবাজার) শুভজিৎ বসু বলেন, ‘‘আন্দোলনকারীদের এক নেতার সঙ্গে আলোচনা চলছে। আশাকরি শীঘ্রই আন্দোলন উঠে যাবে।’’ তাঁর আশ্বাস, আটকে থাকা যাত্রীদের রাতে বাড়ি ফেরানোর ব্যবস্থা করবে প্রশাসন।
বান্দোয়ানের তৃণমূল বিধায়ক তথা দক্ষিণবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণ সংস্থার বোর্ড অব ডিরেক্টর রাজীবলোচন সরেন বলেন, ‘‘সাঁওতাল সমাজের এই আন্দোলনে আমাদের দলের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। তাঁদের দাবি রাজ্য সরকার গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। তবে যাঁরা বাস ভাড়া করেছিলেন, তাঁরা আগে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে, বিষয়টি আমরাও দেখতাম। কেন তাঁরা চাহিদা মতো বাস পেলেন না, তা খোঁজ নিয়ে দেখব।’’
তবে দক্ষিণবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণ সংস্থার ম্যানেজিং ডিরেক্টর গোদারা কিরণ কুমার দাবি করেন, ‘‘শুক্রবার বিকেলে তাঁরা ৪০০ গাড়ি ভাড়া চেয়েছিলেন। এত কম সময়ের মধ্যে অত গাড়ি জোগাড় করে মুশকিল বলে আগেই আমরা জানিয়ে দিয়েছিলাম। তারপরেও ৩০০ গাড়ি আমরা দিই। এরপরেও কেন সমস্যা হল, জানি না।’’
দক্ষিণবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণ সংস্থার আধিকারিকদের একাংশের দাবি, ওই সংগঠনগুলির তরফে বিভিন্ন ব্লকে গাড়ি পাঠানোর জন্য বলা হয়েছিল। কিন্তু সেখানে কার কার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে, তাজানানো হয়নি।
বিষ্ণুপুরের বাঁকাদহ গ্রামের কাছে বৈতল মোড়ে অবরুদ্ধ জাতীয় সড়কে ট্রাকের নীচেই রান্না।
যদিও ভারত জাকাত মাঝি পারগানা মহলের পুরুলিয়া জেলা পারগানা রতনলাল হাঁসদার দাবি, ‘‘পুরুলিয়ায় ২০২টি বাস আসার কথা ছিল। রাতে বিভিন্ন জায়গায় ঝড়বৃষ্টি হওয়ায় ভাবা হয়েছিল, সে কারণে বাস আসতে দেরি করছে। কিন্তু অনেক রাত হয়ে গেলেও বাস পৌঁছয়নি। আমরা বারবার বিভিন্ন লোকজনকে ফোন করি। শেষে পুরুলিয়া ডিপো আমাদের মাত্র ১৪টি বাস দিয়েছিল। অত কম বাস দেওয়ায় নিইনি।’’
ওই সংগঠনের বাঁকুড়া জেলা পারানিক সনগিরি হেমব্রম বলেন, ‘‘বাঁকুড়া জেলার জন্য ৩০০ টির মতো বাস ‘বুক’ করা হয়েছিল। শনিবার বিকেল থেকে ভোর পর্যন্ত কোনও বাস আসেনি। এ দিন সকালের দিকে রাইপুরে ১৪টি বাস পাঠানো হয়েছে। ওই বাস গুলিকেও আটকে রাখা হয়।’’ অনেকে তাঁদের আন্দোলন আটকাতে চক্রান্ত করে এ সব করা হয়েছে বলেও অভিযোগ তোলেন।
ক্ষোভে এ দিন সকাল থেকে অবরোধ শুরু হয়। পুরুলিয়া জেলায় অবরোধ চলে বোরো থানার বুরুডি মোড়ে, বান্দোয়ান থানার কুইলাপাল মোড়ে, মানবাজার থানার দলদাঁড়িয়া ও হুড়া থানার লালপুর মোড়ে। বাঁকুড়া জেলার খাতড়ার খড়বনে অবরোধে আটকে পড়েন জেলা পরিষদের সভাধিপতি তৃণমূলের মৃত্যুঞ্জয় মুর্মু। তিনি বলেন, ‘‘অবরোধের খবর পেয়েই এসেছিলাম। কেন বাস আসেনি, তা জেলা পরিবহণ দফতর জানাতে পারেনি। খোঁজ নিচ্ছি।’’
অবরোধ চলে খাতড়া-বাঁকুড়া রাস্তার খড়বন মোড়, খাতড়া-সিমলাপাল রাস্তার পাঁপড়া মোড়, রানিবাঁধ-ঝিলিমিলি রাস্তার রানিবাঁধ বাজার, বাঁকুড়া-ঝাড়গ্রাম রাস্তায় সারেঙ্গার পিড়লগাড়ি মোড়, রাইপুরের সবুজবাজার, সিমলাপালের স্কুলমোড় ও নদীঘাট এবং বিষ্ণুপুরের বৈতল মোড়-সহ বিভিন্ন জায়গায়।
কোথাও ধামসা-মাদল, তির-ধনুক নিয়ে অবরোধকারীরা বসে পড়েন। কোথাও রাস্তায় গাছের ডাল ফেলে, মাঝ রাস্তায় গাড়ি আটকে দিয়ে অবরোধ চলে। বেলা বাড়লে জমায়েতও বাড়তে শুরু করে। সেই সঙ্গে আটকে যাওয়া লোকজনের ভোগান্তিও বাড়ে।
বাঁকুড়া থেকে কাঁথি যাওয়ার পথে বৈতলে আটকে পড়ে বিয়েবাড়ির একটি বাস। টিঙ্কু মাল বর্ধন নামে ওই বাসের এক যাত্রী বলেন, ‘‘সকাল থেকে বসে আছি। খাবার নেই। কখন ছাড়া পাব, জানি না।’’ খাতড়ার খড়বনে আটকে পড়েন বাঁকুড়া শহরের সোনালি দাস ও জয়ন্ত দাস। তাঁরা বলেন, ‘‘ঝিলিমিলি যাব। সকাল ৮টা থেকে বিকেল পর্যন্ত আটকে রয়েছি।’’ বুরুডি মোড়ে আটকে পড়ে ঝাড়খণ্ড থেকে আসা বরযাত্রীদের গাড়ি। সেখানে আটকে পড়া বান্দোয়ানের অশ্বিনীকুমার মাঝি জানান, সারা দিনটাই নষ্ট হল।
ভারত জাকাত মাঝি পারগানা মহলের গডেৎ বিপ্লব সরেন জানান, বাস ভাড়ার জন্য জমা দেওয়া টাকা ফেরত দেওয়ার আশ্বাস পেয়ে বিকেল সাড়ে ৫টা নাগাদ অবরোধ তুলে নেন। এসডিপিও (খাতড়া) কাশীনাথ মিস্ত্রি বলেন, ‘‘১০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে তাঁদের টাকা ফেরত দেওয়ার চেষ্টা করা হবে এবং প্রতিবাদ রাজ্য স্তরে জানানোর আস্বাস দেওয়ায় তাঁরা অবরোধ তোলেন।’’