এ ভাবেই নদীগর্ভে চলে যাচ্ছে জমি। ছবি: অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়
জলের তোড়ে ভেসে গিয়েছিল গাঁ-ঘর-মাঠ। জল বাড়তে বাড়তে মুছে গিয়েছিল ভিটে-ধানখেত!
২০০০ সালের সেই স্মৃতিই ঘুম কেড়েছে জুনিদপুরের। ফি বছর বর্ষা এলেই গোটা গ্রাম আতঙ্কে রাত জাগে। ভয় একটাই— ফের যদি জল ঢোকে। এই পনেরো বছরে বর্ষা এসেছে, বর্ষা গিয়েছে। সরকার বদল হয়ে রাজ্যে নতুন সরকার এসেছে। গ্রামকে ঘিরে থাকা দ্বারকা নদের বাঁধের ভাঙনের সংস্কার আজও হয়নি!
জুনিদপুর গ্রামের বাসিন্দাদের দাবি, গ্রামের নদী বাঁধের সংস্কার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শুরু করা হোক। গ্রামবাসীর দাবি প্রসঙ্গে মন্ত্রী আশিস বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘নদী বাঁধ সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছে। সেই কাজ বন্ধ হয়ে গিয়েছে কিনা খোঁজ খবর নিয়ে সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করব।’’
সে বারের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলিকে যেন আর ভিটেমাটি হারাতে না হয় তার জন্য স্থানীয় পঞ্চায়েত থেকে পঞ্চায়েত সমিতি, ব্লক অফিস থেকে মহকুমাশাসকের অফিস, সাংসদ থেকে বিধায়ক সকলের কাছে একাধিক বার বাঁধ সংস্কারের আবেদন জানিয়ে এসেছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি! শেষবার বিধানসভা নির্বাচনের আগে বিধায়ক আশিস বন্দ্যোপাধ্যায় যখন গ্রামে গিয়েছিলেন তখনও স্থানীয় বিধায়ককে ঘিরেও গ্রামবাসী তাঁদের সমস্যার কথা জানিয়েছিলেন। বিধায়ককে তাঁরা জানিয়েছিলেন, নদীবাঁধ সংস্কারের দাবির ক্ষেত্রে কোনও রাজনৈতিক দলের প্রতীক দেখবে না। তাঁদের কাছে গ্রাম রক্ষার্থে সমস্যার সমাধান দরকার। জুনিদপুর গ্রামে প্রায় ১০০টি পরিবারের বসবাস। স্থানীয় বরুণ মণ্ডল, নীলকান্ত হাজরারা জানালেন, ‘‘দ্বারকা নদের বাঁধ গ্রামকে ঘিরে আছে। ২০০০ সালের বন্যার সময় গ্রামের উত্তর দিকে নদীবাঁধের প্রায় ৩০০ ফুট অংশ এবং দক্ষিণ দিকের প্রায় ৬০০ ফুট অংশে ভাঙন হয়। সেই ভাঙন এখনও রয়েছে। সামনেই বর্ষা, মেরামত না হলে বিপদ।’’
বিধানসভা নির্বাচন দিন ঘোষণার আগে নদীবাঁধের উত্তর অংশে যেখানে ৩০০ ফুট অংশ ভাঙন ছিল সেখানে সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছিল। হঠাৎ করে সে কাজ বন্ধ বয়ে যায়। সে সময় গ্রামবাসীরা ভোটের সময় কোনও রাজনৈতিক দলকে প্রচার বা দেওয়াল করতে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে পুনরায় কাজ শুরু হয়। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, ‘‘যেভাবে সংস্কার হয়েছে তাতে জলে তোড় আটকাতে পারবে বলে মনে হয় না।’’ গোটা গ্রামেরই ক্ষোভ রয়েছে এ নিয়ে। তাঁরা অভিযোগ করছেন, নদীবাঁধ পাথর দিয়ে বাধানো হয়নি। বাঁধে আরোও বেশি মাটি দেওয়ার প্রয়োজন। বাঁধ সংস্কারের পর বাঁধের উপর পাথরের গুঁড়ো বা মোড়াম না দেওয়ার ফলে বৃষ্টির দিন বাঁধের উপর দিয়ে চলাচল করতে অসুবিধে হয়।
অভিযোগ, নদীবাঁধে যে অংশে ভাঙন প্রায় ৬০০ ফুট সেই অংশ এখনও সংস্কারই শুরু হয়নি। স্থানীয়দের সব থেকে বেশি চিন্তা ওই অংশটি নিয়ে। তাঁদের আশঙ্কা, আসন্ন বর্ষার মরসুম শুরুর আগে সেই অংশে সংস্কারের কাজ না করা হলে জুনিদপুর কেবল নয়, সংলগ্ন পাঁচটি গ্রাম বন্যার কবলে পড়বে। গ্রামবাসী উমাকান্ত মণ্ডল, লক্ষণ মণ্ডলদের কথায়, ‘‘দুই অংশে ভাঙনের ফলে শুধুমাত্র জুনিদপুর নয় আশেপাশে নওয়াপাড়া, কবিচন্দ্রপুর, কৌড়, বালিয়া, খরুণ, আটলা— এই সমস্ত গ্রামগুলিও প্লাবিত হয়। জুনিদপুর গ্রামের দু’জন প্রৌঢ মারা যায়। প্রচুর গবাদিপশুর প্রাণহানি হয়। গ্রামের প্রায় সমস্ত মাটির বাড়ি জলের তোড়ে ধুয়েমুছে সাফ হয়ে যায়। এ বারও এমন হলে, গ্রাম ধুয়ে যাবে!’’ ময়ূরাক্ষী নর্থ ক্যানালের রামপুরহাট বিভাগীয় বাস্তুকার তরুণ রায় চৌধুরী আশার কথা শোনাতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘‘জুনিদপুরের বাঁধ সংস্কারের জন্য কাজ এস্টিমেট পর্যায়ে আছে। মনে হয় না বর্ষার আগে বাঁধ সংস্কারের কাজ শুরু করা যাবে।” যেটুকু কাজ হয়েছে, কারা করেছে সে নিয়েও ছড়িয়েছে বিতর্ক। রামপুরহাট ১ ব্লকের বিডিও নীতিশ বালা বলেন, ‘‘জুনিদপুর গ্রামের নদী বাঁধ সংস্কারের কাজ পঞ্চায়েত সমিতি বা ব্লক থেকে হয়নি। যতদূর জানি পঞ্চায়েত থেকেও হয়নি।’’ তা হলে? আশিসবাবু বলেন, ‘‘কাজটি দেখভাল করছে জেলা পরিষদ।’’ আর জেলা পরিষদের সভাধিপতি বিকাশরায় চৌধুরী বলছেন কাজটা জেলা পরিষদ করছে কিনা সেটাই তাঁর জানা নেই!’’