বিষ্ণপুরের রাসমঞ্চ। —ফাইল চিত্র।
(প্রথম পর্ব)
ঐতিহ্যের সম্ভারে পরিপূর্ণ হয়েও ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যক্ষেত্রের তকমা কেন মিলছে না— সেই উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছে মল্লরাজধানী বিষ্ণুপুর। এ বছর বিষ্ণুপুর পুরসভার দেড়শো বছর পূর্তি উৎসব শুরু হয়েছে। বছরভর চলবে নানা অনুষ্ঠান। অথচ মন্দিরনগরীর অলিগলিতে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে ইউনেস্কোর ‘হেরিটেজ’ তকমা না পাওয়া নিয়ে আক্ষেপ।
বিষ্ণুপুরের মল্লরাজাদের ইতিহাস প্রায় হাজার বছরের প্রাচীন। শহর জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে রাজাদের নির্মিত মন্দির, যা দেখতে দেশ-বিদেশের মানুষের ভিড় জমে শহরে। নিজস্ব সঙ্গীত ঘরানা, চারু ও কারুশিল্পের সম্ভার— এখনও মল্ল রাজাদের স্মৃতি বয়ে নিয়ে চলেছে। এমন একটি ঐতিহাসিক নগরী বিশ্ব ঐতিহ্যক্ষেত্রের তকমা থেকে দীর্ঘদিন বঞ্চিত হয়ে থাকার কারণ নিয়ে বিভিন্ন মহলেই প্রশ্ন উঠছে।
ইউনেস্কোর ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, ১৯৯৮ সালের ৩ জুলাই ঐতিহ্যস্থল হিসেবে ‘টেনটিটিভ’ (শর্তসাপেক্ষ) তালিকায় নাম ওঠে প্রাচীন শহর বিষ্ণুপুরের। তারপর থেকে এ নিয়ে অগ্রগতির কথা প্রকাশ্যে আসেনি।
কী ভাবে ওই তালিকায় নাম উঠেছিল বিষ্ণুপুরের, তার স্পষ্ট উত্তর মেলেনি প্রশাসন, পুরসভা বা জনপ্রতিনিধিরা। তবে বিষ্ণুপুর নিয়ে কাজ করা গবেষকদের একাংশের দাবি, নব্বইয়ের দশকে বাঁকুড়া জেলা প্রশাসন রাজ্য পর্যটন দফতরের কাছে বিষ্ণুপুরকে ইউনেস্কোর হেরিটেজ তালিকায় আনার জন্য আবেদন করেছিল। সেই আবেদনের প্রেক্ষিতে প্রক্রিয়া শুরু হয়। ইউনেস্কোর প্রতিনিধিরা সাবেক মল্লরাজধানী পরিদর্শন করে গিয়েছিলেন। তৎকালীন সময়ে এ নিয়ে প্রশাসনিক স্তরে বৈঠকও হয়। তারপর আর কাজ এগোয়নি।
কোথায় থমকে গেল স্বীকৃতি আদায়ের লড়াই? বাঁকুড়া জেলা প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, “এ নিয়ে হয়ত রাজ্য পর্যটন দফতর কিছু বলতে পারবে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এ নিয়ে কোনও আলোচনা শুনিনি।”
হেরিটেজ স্বীকৃতি আদায়ের লড়াইয়ে কেন পিছিয়ে গিয়েছে মল্লরাজধানী এনিয়ে কিছু তথ্য তুলে ধরেন বিষ্ণুপুর নিয়ে গবেষণায় যুক্ত পাঁচমুড়া কলেজের প্রাক্তন শিক্ষক নীহারকান্তি হাজরা। তিনি জানান, ইউনেস্কোর প্রতিনিধি দলের সদস্যেরা শহর পরিদর্শনে এসে মন্দির সংলগ্ন এলাকাগুলির পরিবেশ, পরিকাঠামো দেখে খুশি হতে পারেননি। সেই সময় পুরসভার কাছ থেকে বিষ্ণুপুরের ভৌগোলিক মানচিত্র চেয়েও পাওয়া যায়নি। এমনকি হেরিটেজ কমিটি পর্যন্ত গড়া হয়নি।
তিনি বলেন, “মন্দিরের জমি অধিগ্রহণ হয়ে যাওয়া, ভৌগোলিক মানচিত্র না থাকার মতো বিষয়গুলি ভাল ভাবে নেননি ইউনেস্কোর প্রতিনিধিরা। তৎকালীন পুরসভার তরফেও কিছুটা অসহযোগিতা ছিল। এ সব কারণেই বিশ্ব ঐতিহ্যক্ষেত্রের তকমা থেকে বঞ্চিত রয়ে যায় মল্লরাজধানী।”
তাঁর আক্ষেপ, “গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক জায়গাগুলিতে অবৈধ নির্মাণ, ঐতিহ্যবাহী বাঁধগুলিকে বুজিয়ে জমি বিক্রি, পরিখার জমি দখল হয়ে যাওয়া, প্রাচীন টিলাগুলি ধ্বংস করে মাটি চুরি করার মতো ঘটনায় বিষ্ণুপুর তার ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলছে। অবিলম্বে এ সব রুখতে আইনগত ভাবে কড়া ব্যবস্থা না নিলে যেটুকু ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে, তা-ও হারিয়ে ফেলবে মল্লরাজধানী।”
বিষ্ণুপুরের পুরপ্রধান গৌতম গোস্বামী বলেন, “অতীতে কারা কী করেছেন, তা আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। তবে এখন আমরা বিষ্ণুপুরকে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে পরিকল্পনা মাফিক ধাপে ধাপে এগোচ্ছি। শহরের প্রাচীনত্ব রক্ষায় আমরা বিশেষ সতর্ক।”
তবু আক্ষেপ যাচ্ছে না। বিষ্ণুপুরের আচার্য যোগেশচন্দ্র পুরাকৃতি ভবনের কিউরেটর তুষার সরকার বলেন, হেরিটেজ স্বীকৃতি আদায়ের জন্য যতটা তৎপরতা দরকার তাতে কোথাও খামতি থেকে যাচ্ছে কি না এ বার তা পর্যালোচনা করার সময় হয়ত এসেছে।
বিষ্ণুপুরের রামশরণ সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ সুজিত গঙ্গোপাধ্যায়ের আক্ষেপ, “নিজস্ব ইতিহাস, কলা ও সংস্কৃতির দৌলতে বিষ্ণুপুর অনন্য হেরিটেজ তকমা না পাওয়ার দায় বিষ্ণুপুরবাসীরও। হতে পারে আমরাই সঠিক জায়গায় চাপ দিতে পারছি না। প্রশাসনের উচিত বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে ভাবা।”
বিষ্ণুপুরের বিধায়ক তন্ময় ঘোষের আশ্বাস, “রাজ্য পর্যটন দফতরের সঙ্গে আলোচনা করে হেরিটেজ তকমা পেতে প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণের জন্য চেষ্টা করা হবে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গেও ব্যক্তিগত ভাবে বিষয়টি নিয়ে কথা বলব।” (চলবে)