সাবেক পৌষমেলা। আনন্দবাজারের আর্কাইভ থেকে
তথ্য বলছে, প্রথম পৌষমেলায় খরচ হয়েছিল ১৭৩২ টাকা ১০ আনা। সেই খরচ কবেই লক্ষ টাকা পেরিয়ে কোটি ছোঁয়ার মুখে।
কেমন ছিল সে যুগের মেলা, এখনইবা কী রকম? সে কথা অনেকেরই মুখে মুখে ঘুরল বুধবার। পৌষ উৎসব নাকি পৌষমেলা, কোনটা জরুরি? দূষণ এড়াতে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের মেলার পুরনো দিনে ফিরে যাওয়া উচিত কি না, তা নিয়েও চলল চর্চা।
কিন্তু, এর আগে কি কখনও মেলা বন্ধ হয়েছে? উত্তর মিলল প্রবীণ আশ্রমিকদের থেকে। স্মৃতি আবছা হয়েছে। তবু তাঁদের মনে আছে, ১৯৪৩ সালে এবং ১৯৪৬ সালে পৌষমেলা হয়নি।
যদিও দুটি বছরেই রীতি মেনে পৌষ উৎসব হয়েছিল। মন্বন্তর এবং সাম্প্রদায়িক হানাহানির কারণে মেলা বন্ধ হয়েছিল তখন। বর্তমানে কারণ অবশ্য ভিন্ন।
পৌষমেলা শুরুর গল্প শান্তিনিকেতনে নয়। কলকাতার কাছে গোরিটির বাগানে। ১৮৪৩ সালে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ঠিক করেন, দীক্ষিত ব্রাহ্মদের নিয়ে মেলা করবেন। আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘পরস্পরের এমন সৌহার্দ্য দেখিলাম, তখন আমার মনে বড়ই আহ্লাদ হইল। আমি মনে করিলাম যে, নগরের বাহিরে প্রশস্ত ক্ষেত্রে ইঁহাদের প্রতি পৌষমাসে একটা মেলা হইলে ভাল হয়।’ ১৮৪৫-এর ৭ পৌষ, মেলা বসল গোরিটির বাগানে। প্রায় ১৭ বছর পর রায়পুরের জমিদারের কাছ থেকে মৌরসীস্বত্ত্বে কিনে নিলেন তাঁর অনুভূত শান্তির আশ্রয়। ১৮৮৮ সালের ৮ মার্চ হওয়া ট্রাস্টডিডে শান্তিনিকেতনে পৌষমেলা আয়োজনের নির্দেশ দেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেখানে লিখেছেন, ‘ধর্মভাব উদ্দীপনের জন্য ট্রাস্টীগণ বর্ষে বর্ষে একটি মেলা বসাইবার চেষ্টা ও উদ্যোগ করিবেন। এই মেলাতে সকল ধর্মসম্প্রদায়ের সাধুপুরুষেরা আসিয়া ধর্মবিচার ও ধর্মালাপ করিতে পারিবেন। এই মেলার উৎসবে কোনও প্রকার পৌত্তলিক আরাধনা হইবে না ও কুৎসিত আমোদ উৎসব হইতে পারিবে না; মদমাংস ব্যতীত এই মেলায় সর্বপ্রকার দ্রব্যাদি খরিদ-বিক্রয় করিতে পারিবে। যদি কালে এই মেলার দ্বারা কোনোরূপ আয় হয়, তবে ট্রাস্টীগণ ঐ আয়ের টাকা মেলার কিংবা আশ্রমের উন্নতির জন্য ব্যয় করিবেন।’
শান্তিনিকেতনে পৌষমেলা প্রথম বসে ১৮৯৪ সালে, ৭ পৌষ, মন্দিরের পাশের মাঠে। সেই সময় এই মেলা ছিল মানুষে-মানুষে আন্তরিক যোগ-সাধনের উপলক্ষ। সময় পেরিয়েছে, বদলেছে মেলার উদ্দেশ্য, লক্ষ্য। একাধিকবার স্থান পরিবর্তনও হয়েছে পৌষমেলার। পৌষ উৎসবের সঙ্গে পৌষমেলা জড়িয়ে গিয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘শান্তিনিকেতন’ গ্রন্থের প্রথম খণ্ডের ‘শান্তিনিকেতনে ৭ই পৌষের উৎসব’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘উৎসব তো আমরা রচনা করতে পারি নে, যদি সুযোগ হয় তবে উৎসব আমরা আবিষ্কার করতে পারি।’ কোনও এক বছর ৭ পৌষ এই কথা লিখেছিলেন। একই দিনে তাঁর লেখা ঠিক তার পরের প্রবন্ধ ‘দীক্ষা’য় উঠে আসছে দিনটির মাহাত্ম্যের কথা। ৮ পৌষ লেখা পরের প্রবন্ধ ‘মানুষ’-এ লিখছেন, ‘কালকের উৎসবমেলার দোকানি-পসারিরা এখনও চলে যায় নি।’ ৯ পৌষে লেখা প্রবন্ধ ‘উৎসবশেষ’-এ লিখেছেন, ‘আমরা অনেক সময় উৎসব করে ফতুর হয়ে যাই। ঋণশোধ করতেই দিন বয়ে যায়।’
প্রথম খণ্ডের এই প্রবন্ধগুলি থেকে সে কালের পৌষ উৎসব এবং মেলার একটা ধারণা পাওয়া যায়। দুটি যে সমান্তরালে চলেছে, তাও বোঝা যায়। এই অবস্থায় একটি বাদ দিয়ে আর একটি কী ভাবে সম্ভব, তা নিয়েও প্রশ্ন ঘুরছে।