দুই পড়শির বিবাদ। পুরভোটের মুখে তাতেই লেগে গেল রাজনৈতিক রং। পুলিশের বিরুদ্ধেও উঠল পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ। প্রতিবাদে শহরে মিছিল করল একটি রাজনৈতিক দল। বাঁকুড়া পুরসভার ১১ নম্বর ওয়ার্ডের কবরডাঙা এলাকায় শনিবারের একটি গোলমালকে কেন্দ্র করে রবিবারও শহরে রইল তার জের।
বিষয়টির মধ্যে নাম জড়িয়েছে সিপিএমের প্রাক্তন পুরপ্রধান তথা ১১ নম্বর ওয়ার্ডের বিদায়ী কাউন্সিলর শিউলি মিদ্যা ও তাঁর স্বামী প্রাক্তন কাউন্সিলর শ্যামল মিদ্যার। এ ছাড়াও আর এক বামপন্থী মনোভাবাপন্ন শিক্ষক-সহ পাড়ার দুই পড়শি পরিবারের সদস্যদেরও নাম জড়িয়েছে। শনিবার রাতে তাঁদের বাড়িতে গিয়ে পুলিশ কড়া নেড়েছে, এই অভিযোগ তুলে রবিবার বিকেলে বাঁকুড়া শহরে প্রতিবাদ মিছিলও করে বামফ্রন্ট।
কবরডাঙা এলাকার বাসিন্দা নাজমেনুর বিবি এলাকার সক্রিয় সিপিএম কর্মী বলে পরিচিত। অন্য দিকে, তাঁর পড়শি সেখ মুজিবর তৃণমূলপন্থী হিসেবে পরিচিত। শনিবার বিকেলে সেখ মুজিবরের মেয়ে চায়না খাতুনের সঙ্গে নাজমেনুর বিবির বিবাদ বাধে পাড়ার কলতলায়। চায়নার অভিযোগ, ‘‘আমি কলতলায় কাপড় কাচছিলাম। হঠাৎ নাজমেনুর এসে আধবালতি জল ভরে আমার গায়ে ঢেলে দেয়। প্রতিবাদ করলে নাজমেনুরের তিন ছেলে এসে আমাকে এবং বাড়ির লোকজনকে মারধর শুরু করে। ঘরে ঢুকেও তারা তাণ্ডব চালায়।’’ চায়না-সহ জখম হন তাঁর দিদি জাহানারা বেগম ও ভাই সেখ আসাদুল। তিনজনেই বাঁকুড়া মেডিক্যালে চিকিৎসাধীন। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, হামলার সময় উপস্থিত ছিলেন শিউলিদেবী ও শ্যামলবাবু। অন্যদিকে নাজমেনুরের দাবি, ‘‘আমি বোতলে জল ভরছিলাম। ছিটেফোঁটা জল গিয়ে লাগে চায়নার গায়ে। তাতেই ঝগড়া শুরু করে পাড়া মাথায় তোলে। এরপর বাড়ির ছাদ থেকে চায়নার পরিবারের লোকজন ইট বৃষ্টি শুরু করে। ইটের ঘায়ে জখম হয় আমার ছেলে পাপ্পু খান ও সানিম খান।’’ তাঁদেরও বাঁকুড়া মেডিক্যালে ভর্তি করা হয়। ঝামেলার খবর পেয়েই ঘটনাস্থলে যায় পুলিশ বাহিনী।
কিন্তু বিষয়টি মোটেই পড়শিদের মামুলি ঝামেলা নয় বলেই বাসিন্দাদের দাবি। দুই পরিবারের কথাতেও তা স্পষ্ট। চায়নাদেবী বলেন, “আমাদের বাড়ির দেওয়ালে তৃণমূল প্রার্থী অলকা সেন মজুমদারের নাম লেখা হয়েছে। তাই কিছুদিন আগেই হুমকি দিয়ে গিয়েছিলেন শিউলিদেবী। এ দিন ওঁরাই চক্রান্ত করে আমাদের উপর হামলা চালিয়েছে।’’ আর এতেই ঘটনাটিতে রাজনৈতিক রং লেগে গিয়েছে। শনিবার রাতেই থানায় অভিযোগ দায়ের করেন দু’পক্ষ। চায়না তাঁর অভিযোগ পত্রে অবশ্য কলতলার গোলমালের কথা উল্লেখ করেননি। উল্টে দেওয়াল লিখনকে কেন্দ্র করে তাঁদের বাড়িতে হামলা, লুঠপাট, শ্লীলতাহানি-সহ বেশ কিছু জামিন অযোগ্য ধারায় অভিযোগ দায়ের করেন শিউলিদেবী, শ্যামলবাবু, এক বামপন্থী শিক্ষক সহ নাজমেনুরের পরিবারের চারজনের বিরুদ্ধে। অভিযোগের পরেই অভিযুক্তদের গ্রেফতারের দাবিতে সরব হয় তৃণমূল। ১১ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল প্রার্থী অলকা সেন মজুমদার তাঁর অনুগামীদের নিয়ে বাঁকুড়া সদর থানায় প্রায় মাঝ রাত পর্যন্ত উপস্থিত থেকে পুলিশের কাছে গ্রেফতারের দাবি তোলেন। শাসকদলের কর্মীদের সঙ্গে চাপান উতোর শুরু হয় পুলিশের। নাজমেনুরও চায়নাদেবীর পরিবারের লোকেদের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে লিখিত ভাবে অভিযোগ জানিয়েছেন। রবিবার পর্যন্ত পুলিশ অভিযুক্ত কাউকেই গ্রেফতার করেনি।
কিন্তু ওই ঘটনাকে ঘিরে পুলিশের বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ তুলেছেন সিপিএম নেতৃত্ব। শনিবার মাঝরাতে কেন পুলিশ শিউলিদেবী ও অভিযুক্ত বামপন্থী শিক্ষকের বাড়িতে গিয়েছিল, তা নিয়ে তুমুল বিতণ্ডা শুরু হয়েছে পুলিশ ও সিপিএমের শহর নেতৃত্বের মধ্যে। পুলিশ গিয়ে ওই দু’ডনের বাড়ির দরজায় কড়া নাড়েন বলে সিপিএম নেতৃত্বের দাবি। শিউলিদেবী যদিও দরজা খোলেননি। ওই শিক্ষকও বাড়িতে ছিলেন না। জেলা পুলিশের এক কর্তা বলেন, “এলাকায় শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখাই আমাদের লক্ষ্য। নতুন করে শহরে কোনও ঝামেলা হচ্ছে কিনা, তা দেখতেই কয়েকজনের বাড়ির আশপাশে টহল দেওয়া হয়।’’ দরজায় কড়া নাড়ার অভিযোগ কিন্তু মানতে চাননি ওই পুলিশকর্তা।
ভোটের আগে ঘটনাটিকে অবশ্য সহজে ছাড়তে নারাজ সিপিএমও। রাতে সিপিএম কর্মীদের বাড়িতে পুলিশ যাওয়ার প্রতিবাদে রবিবার শহরে মিছিল করে বাঁকুড়া সদর থানার ওসি এবং জেলাশাসকের কাছে স্মারকলিপি দেন বামফ্রন্ট নেতৃত্ব। বামেদের তরফে মিথ্যা অভিযোগ প্রত্যাহার ও নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি তোলা হয়েছে।
সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য সুবিকাশ চৌধুরী বলেন, “মাঝরাতে আমাদের কর্মীদের বাড়িতে গিয়ে পুলিশ অসভ্য আচরণ করেছে। শাসকদলের উস্কানিতেই এই কাজ করেছে পুলিশ। একটি অরাজনৈতিক বিষয়কে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে রাজনৈতিক ঘটনা বলে দেখানো হচ্ছে।” শিউলিদেবীর বক্তব্য, “ঘটনাটি যাতে দ্রুত মিটে যায় তার জন্য পুলিশের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করেছি আমি। পুলিশ জানে আমার ও আমার স্বামী এবং ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ তোলা হচ্ছে সব মিথ্যা। কিন্তু তার পরেও তৃণমূলের প্ররোচনায় মাঝরাতে আমাদের বাড়ি গিয়ে অপদস্থ করল পুলিশ।” তৃণমূল প্রার্থী অলকাদেবী অবশ্য দাবি করেছেন, ‘‘ওই পরিবারটি তৃণমূল করে বলেই তাঁদের উপরে জুলুম করছে সিপিএম। আমরা ওদের কড়া শাস্তির দাবি থেকে সরছি না।”