আদালতে রায় শুনতে হাজির শবরদের অনেকে। নিজস্ব চিত্র
‘বুধন শবর’ যেন শবর সম্প্রদায়ের এক আন্দোলনের নাম। সোমবারটা যেন তাঁদের মাথা উঁচু করার দিন।
২৫ বছর ধরে আইনি লড়াই চালিয়ে সত্য প্রতিষ্ঠার দিনে সোমবার তাই পুরুলিয়া আদালতে এসে বুধনের স্ত্রী শ্যামলী শবর দেখলেন, তাঁর পাশে দাঁড়াতে এসেছেন অনেকে। শুধু কেন্দা থানার তাঁর গ্রাম অকড়বাইদ থেকেই নয়, হাজির হয়েছিলেন জেলার বিভিন্ন এলাকার শবর সম্প্রদায়ের মানুষজন।
তবে আদালতের কর্মীরা কর্মবিরতি করায় এ দিন সাজা ঘোষণা হবে কি না, তা নিয়ে দিনের শুরুতে বিভ্রান্তি ছড়ায় গ্রামবাসীর মধ্যে। পরে জানা যায়, এ দিনই সাজা ঘোষণা করা হবে। কতক্ষণে কী সাজা বিচারক দেবেন, তা জানতে কৌতুহল তৈরি হয়। তাঁরা শ্যামলীর পাশে সকাল থেকে ঠায় ছিলেন আদালতের বারান্দায়।
সাজা ঘোষণার পরে অনেকের চোখ জলে ভরে যায়। বাবার মৃত্যুর মামলার রায় শুনতে এ দিন শ্যামলীর সঙ্গে এসেছিলেন তাঁর বড় ছেলে ভূদেব শবর। তিনি বলেন, ‘‘বাবার মৃত্যু যখন হয় তখন আমি খুবই ছোট। বাবাকে খুব স্পষ্ট করে মনেও নেই। বড় হতে মায়ের কাছে সব শুনেছি। সমিতির দাদুদের কাছে শুনেছি, বাবাকে নির্দয় ভাবে মারা হয়েছিল। যত শুনতাম ততই মন খারাপ হয়ে যেত। এই দিনটার অপেক্ষায় এত দিন ছিলাম।’’
রায় শুনে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেন বুধনের পড়শি মঙ্গল শবর। তাঁর কথায়, ‘‘সেই দিনগুলো কি কখনও ভুলতে পারব? কোনও অপরাধ ঘটলেই পুলিশ আমাদের তাড়া করত। সে সব আতঙ্কের দিন ভোলার নয়। বুধন আমাদের উপরে নির্যাতনের প্রতিবাদ। আজ ভাল লাগছে।’’ শবর কন্যাদের মধ্যে প্রথম স্নাতক রমণিতা শবরও আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
সমিতির সভানেত্রী রত্নাবলী শবর বলেন, ‘‘এক সময়ে ‘অপরাধ প্রবণ জনজাতি’-র তকমা আমাদের উপরে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পরে তা প্রত্যাহার করা হলেও বাস্তব ছবিটা বুধন শবরের ঘটনাই দেখিয়ে দেয়। এই রায় অনেক অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার রায়।’’
সেই সুরেই ‘পশ্চিমবঙ্গ খেড়িয়া শবর কল্যাণ সমিতি’র অধিকর্তা প্রশান্ত রক্ষিত এ দিন আদালতে বলেন, ‘‘বুধন আমাদের কাছে বা শবর সম্প্রদায়ের মানুষজনের কাছে কোনও ব্যক্তি নন, ইংরেজি সরকার যাঁদের অপরাধপ্রবণ জনজাতি হিসেবে ঘোষণা করেছিল, সে রকম ১৯৮টি জনজাতির মানুষের কাছে এক আন্দোলনের নাম।’’ তিনি জানান, বুধনের কথা আজ সারা দেশ জানে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন, সমাজকর্মীরা বুধনকে জানেন মহাশ্বেতাদেবীর জন্যই। বুধনের স্ত্রী শ্যামলীর লড়াইয়ে আমৃত্যু পাশে থেকেছেন মহাশ্বেতাদেবী। এ দিন সেই লড়াইয়ের ন্যায় প্রতিষ্ঠা হল। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা কিন্তু পুলিশ বিভাগের বিরুদ্ধে নই। যে বা যাঁরা এই নির্মম ঘটনার জন্য দায়ী আমাদের লড়াই ছিল তাঁর বা তাঁদের বিরুদ্ধে।’’