পুলিশের ভূমিকার প্রতিবাদে সিপিএমের মিছিল রামপুরহাটে।—নিজস্ব চিত্র।
শহরে কোথাও কিছু ঘটলেই বিরোধী দলের লোকেদের তিনি থানায় তুলে আনেন বলে অভিযোগ। বিরোধী নেতাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।
এ রকম একাধিক অভিযোগ তুলে রামপুরহাট থানার আইসি-র বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই সরব হয়েছে বিরোধীরা। তাদের দাবি, ওই আইসি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে শাসকদল তৃণমূলের হয়ে কাজ করছেন। প্রতিবাদে পুলিশ-প্রশাসনের কর্তাদের কাছে লিখিত অভিযোগ, স্মারকলিপি, বিক্ষোভ, মিছিল— কিছুই বাদ রাখেনি বিরোধীরা। রিটার্নিং অফিসারের মাধ্যমে অভিযোগ পাঠানো হয়েছে রাজ্য নির্বাচন কমিশনেও। কিন্তু, এখনও পর্যন্ত চিঁড়ে ভেজেনি। এ বার শহরজুড়ে শুরু হয়েছে পোস্টারিংও। প্রথমে আইসি-র বিপক্ষে লেখা পোস্টারে ভরে গিয়েছিল শহর। তার দিন কয়েক পরেই অভিযুক্ত আইসি-র গুণগান করেও প়ড়ল পাল্টা পোস্টার। সোমবার আইসি-র বদল চেয়ে শহরে বড় মিছিল করল সিপিএমও। এ ভাবেই পুরভোটের এই উত্তপ্ত বাজারে হঠাৎ করে চর্চার কেন্দ্রে চলে এসেছেন রামপুরহাটের আইসি আবু সেলিম!
ঘটনা হল, গত শনিবার সকালে হঠাৎ-ই শহরের বিভিন্ন দেওয়ালে বাসিন্দাদের কিছু পোস্টার নজরে আসে। ‘নাগরিক অধিকার রক্ষা কমিটি রামপুরহাট’ নামে নানা রংয়ের পোস্টারে আইসি-র বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ তোলা হয়। তার কয়েকটিতে যেমন লেখা ছিল— ‘তোলাবাজ, অমানবিক অহংকারী পুলিশ প্রশাসনের সম্মান নষ্টকারী রামপুরহাট আইসি-র অপসারণ চাই’, ‘সিভিক পুলিশদের দিয়ে টাকা তোলা বন্ধ করুন’ ইত্যাদি। রবিবার সকালে আবার ‘সৌজন্যে- রামপুরহাট শহরবাসী’ নাম দিয়ে আইসি-র পক্ষে পাল্টা পোস্টার পড়ে। সাদা কাগজে ছাপানো ওই সব পোস্টারে লেখা রয়েছে, ‘রাজনৈতিক স্বার্থে পুলিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে শহরের নাগরিকবৃন্দদের আঁধারে রেখে পোস্টারিং করা ব্যক্তিদের জানাই ধিক-ধিক-ধিক্কার’, ‘রামপুরহাটের অসামাজিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে রামপুরহাট থানার আইসি-র সুচিন্তাধারা শহরজুড়ে ছড়িয়ে দিন’ ইত্যাদি। যা দেখে শুনে সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য সঞ্জীব বর্মণ বলছেন, ‘‘ভোটের মরসুমে আইসি-ই দেখছি সবার বাজার কেড়ে নিচ্ছেন! উনিই এখন শহরে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। তবে, আইসি রামপুরহাটে যে কাজ করে যাচ্ছেন, এই সংস্কৃতি আগামী দিনে শহরবাসীরই ক্ষতি করবে।’’
আইসি-ই কেন বিতর্কের কেন্দ্রে?
গত ফেব্রুয়ারি মাসে মাধ্যমিক পরীক্ষা চলাকালীন প্রথম সরব হয়েছিল এসইউসি। দলের অভিযোগ, স্মারকলিপি দেওয়ার সময়ে আইসি থানা চত্বরে দলের কর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছেন। শহরের দুই নেতাকে অপমানও করেছেন। এর প্রতিবাদে তখন শহরজুড়ে প্রতিবাদ মিছিল বের করে এসইউসি। আবু সেলিমের বদলি চেয়ে এসডিও এবং এসডিপি-র কাছে স্মারকলিপিও দেয়। গত ১৯ মার্চ আইসি-র বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ তুলে এসডিও এবং এসডিপিও-কে স্মারকলিপি দেয় কংগ্রেসও। একই দাবিতে সরব হয় বামফ্রন্টও। এর পরে মার্চের শেষ সপ্তাহে সিউড়িতে সাংবাদিক বৈঠক করে আইসি-র বিরুদ্ধে সরাসরি তৃণমূলের হয়ে কাজ করার অভিযোগ তুলে সরব হন বিজেপি-র জেলা সভাপতি অর্জুন সাহা। দলের পক্ষে অভিযোগ জানানো হয় জেলার পুলিশ সুপারের কাছেও। গত শুক্রবারই আবার নির্বাচন নিয়ে এসডিপিও (রামপুরহাট) জোবি থমাসের ডাকা একটি সর্বদলীয় বৈঠকে বিষয়টি ওঠে। সেখানে তৃণমূল ছাড়া বাকি সব দলের প্রতিনিধিরা শহরে শান্তিপূর্ণ ভাবে ভোট করার ক্ষেত্রে সবার আগে আইসি-র বদলির দাবি তোলেন।
কেন বদলি চান বিরোধীরা?
শহরের প্রাক্তন পুরপ্রধান তথা জেলা কংগ্রেস সভাপতি সৈয়দ সিরাজ জিম্মির বক্তব্য, ‘‘এই শহরের মানুষ পুলিশ-প্রশাসনের কাজে আস্থা রাখেন। কিন্তু, বর্তমান আইসি-র কাজে সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ। তারই ছাপ পড়েছে সাম্প্রতিক পোস্টারিংয়ে। আইসি-র চেয়ারকে কলুষিত করে আবু সেলিম তৃণমূলের হয়ে কাজ করছেন। তিনি এমন মহান কিছু করেননি যে শহরবাসী তাঁর হয়ে সুখ্যাতি করবে। আসলে ওই আইসি যে দলের হয়ে পক্ষপাত দেখান, সেই তৃণমূলের লোকেরাই তাঁর পক্ষে পাল্টা পোস্টার দিয়েছে।’’ অন্য দিকে, আবু সেলিম রামপুরহাটের আইসি থাকা অবস্থায় রামপুরহাটে কখনই অবাধ নির্বাচন সম্ভব নয় বলেই দাবি করেছেন সঞ্জীববাবু। আবার বিজেপি-র জেলা সহ-সভাপতি শুভাশিস চৌধুরী বলছেন, ‘‘আমরা চাই রামপুরহাটে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ ভোট হোক। তার জন্যই এই পক্ষপাতে দুষ্ট আইসি-কে বদলি করতে হবে।’’
বস্তুত, আবু সেলিমকে নিয়ে বিতর্ক এই প্রথম নয়। কয়েক বছর আগে রেশন-কাণ্ডে কেতুগ্রামে থানায় পুলিশের গুলিতে এক বিক্ষোভকারীর মৃত্যু হয়েছিল। ওই ঘটনায় গুলি চালিয়ে বিতর্কের কেন্দ্রে চলে এসেছিলেন কেতুগ্রাম থানার তৎকালীন ওসি এই আবু সেলিমই।
এ দিকে, বিরোধীদের এই সব অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলেই দাবি করেছে শাসকদল। তৃণমূলের রামপুরহাট ১ ব্লক সভাপতি আনারুল হোসেন বলছেন, ‘‘সবই মিথ্যা অভিযোগে। আইসি আইন মেনেই কাজ করছেন।’’ অন্য দিকে, এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে অভিযুক্ত আইসি বলেন, ‘‘অভিযোগগুলির বিষয়ে আমি কোনও মন্তব্যই করতে চাই না। যা বলার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষই বলবেন। শহরে কারা কী পোস্টার মারছে, তা নিয়েও আমি ভাবিত নই। আমি আমার কাজ করছি।’’ এসডিপিও (রামপুরহাট) জোবি থমাসের বক্তব্য, ‘‘আমার কাছে কেউ সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দেননি। অভিযোগ আসলে খতিয়ে দেখব।’’ তবে, এসডিও উমাশঙ্কর এস বলেন, ‘‘অভিযোগ পেয়েই জেলা নির্বাচন আধিকারিক হিসাবে জেলাশাসককে পাঠিয়ে দিয়েছি।’’ জেলাশাসক পি মোহন গাঁধী জানান, এসপি-কে এ বিষয়ে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। এসপি ফোন ধরেননি। এসএমএস-এরও জবাব দেননি।