আশা দেব। নিজস্ব চিত্র
কলকাতার ভিটে ছেড়ে বান্দোয়ানের জঙ্গলে ঘুরে মানুষজনকে সুস্থ রাখার কাজ করে গিয়েছেন বছরের পর বছর। আশা দেব নামে ওই এএনএম (অক্সিলারি নার্স মিডওয়াইফারি) লেলহে মৌমাছির হামলায় ভেন্টিলেশনে রয়েছেন শুনে, এ বার তাঁকে বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন বান্দোয়ানবাসী। নিজের আচরণ ও কাজের গুনে সবার জনপ্রিয় হয়ে ওঠা ওই স্বাস্থ্যকর্মী এখন টাটার একটি বেসরকারি হাসপাতালে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে লড়াই চালাচ্ছেন।
বান্দোয়ান ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্র চত্বরে থাকা উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ওই কর্মী সোমবার সকালে কুষ্ঠ রোগের সমীক্ষা সেরে বান্দোয়ানের কড়ামি গ্রাম থেকে জঙ্গল পথে হেঁটে বাড়ি ফিরছিলেন। সেই সময় তাঁকে ছেঁকে ধরে লেলহে মৌমাছির দল। বাসিন্দারা তাঁর চিৎকার শুনে দৌড়ে এসে মৌমাছি তাড়ানোর চেষ্টা করেন। সেখান থেকে ফোন পেয়ে বান্দোয়ানের বাসিন্দা মহম্মদ আকিল, মহাদেব বন্দ্যোপাধ্যায়, গোবিন্দ অগ্রবালরা যখন কড়ামি গ্রামে পৌঁছন ততক্ষণে বছর আটান্নর আশাদেবীর বেহুঁশ অবস্থা। তাঁরা বান্দোয়ান থেকে অ্যাম্বুল্যান্স নিয়ে এসে আশাদেবীকে উদ্ধার করে নিয়ে যান।
বান্দোয়ানের বিএমওএইচ জয়দেব সোরেন বলেন, ‘‘আশাদেবীকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আনা হয়। আমরা প্রাথমিক চিকিৎসাটুকু করে উন্নত চিকিৎসার জন্য বড় কোনও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যেতে বলি।’’ খবর পেয়ে ততক্ষণে বান্দোয়ান স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বহু মানুষ জড়ো হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁরাই নিজেদের মধ্যে টাকা জোগাড় করে আশাদেবীকে টাটার বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। মহম্মদ আকিল বলেন, ‘‘আশাদেবী অবিবাহিত। বৃদ্ধ বাবা ছাড়া আর কেউ নেই। সারাজীবন অন্যের সেবা করে গিয়েছেন। নিজের আচরণের গুনে তিনি সবার প্রিয়। সেই জন্য স্থানীয় চ্যালেঞ্জার্স ক্লাব, যুবভারতী, বান্দোয়ান স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যেরা সবাই মিলে ঠিক করি, এখান থেকে বাঁকুড়া মেডিক্যাল হাসপাতালের দূরত্ব প্রায় ১০০ কিলোমিটার। তুলনায় চল্লিশ কিলোমিটারের মধ্যে টাটার বেসরকারি হাসপাতাল কাছে। সবাই মিলে সোমবার সন্ধ্যায় তাঁকে টাটার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করাই।’’
বান্দোয়ানের বিএমওএইচ বলেন, ‘‘লেলহে মৌমাছির বিষ মারাত্মক। টাটার বেসরকারি হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, আশাদেবী ভেন্টিলেশনে রয়েছেন। তাঁর পালস্ অনিয়মিত, রক্তচাপও স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। তবে ওখানকার চিকিৎসকেরা আশা দিয়েছেন।’’
স্থানীয় বাসিন্দা মহাদেব বন্দ্যোপাধ্যায়, বিমল রুহিদাসরা বলেন, ‘‘এ পর্যন্ত আশাদেবীর চিকিৎসার জন্য ৭৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু তিনিই পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী। তাই তাঁর চিকিৎসার খরচ জোগাতে ক্লাবগুলির ছেলেরা চাঁদা তুলছেন। এ পর্যন্ত ৫০ হাজার টাকা উঠেছে। অনেকেই আরও টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।’’
এক জন স্বাস্থ্যকর্মী হয়েও এতটা জনপ্রিয় হলেন কী ভাবে? বিএমওএইচ বলেন, ‘‘আশাদেবী তাঁর কাজের গুনে সকলের প্রিয়। প্রায় তিন দশক ধরে তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। তাই তাঁর বিপদ শুনে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।’’ তিনি জানান, আমজনতার সঙ্গে চিকিৎসক-সহ সমস্ত স্বাস্থ্যকর্মীরা তাঁর চিকিৎসায় আর্থিক সাহায্য নিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন। এ জন্য একটি তহবিল গড়ে তোলা হয়েছে। বাসিন্দারাও জানান, আশাদেবীকে বাঁচিয়ে তোলাই তাঁদের এখন একমাত্র লক্ষ্য।
আশাদেবীর বাবা ৮৫ বছরের গোপাল দেব বলেন, ‘‘আমাদের বাড়ি কলকাতায় হলেও মেয়েটা কখন বান্দোয়ানবাসীর এতটা কাছের হয়ে গিয়েছে বুঝিনি। বয়সের ভারে হাসপাতালে যেতে পারছি না। এখানকার ছেলেগুলোই চিকিৎসার জন্য টাকা তুলছে, ডাক্তারদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করছেন, এতটা বোঝ হয় বাড়ির লোকেও করত না!’’