উড়ান: এই পরিযায়ী পাখিদের আনাগোনা এ বার কমেছে বলে দাবি। ছবি: শুভ্র মিত্র
ভুটভুটির শব্দে খানখান হচ্ছে বাঁধের চেনা নির্জনতা। বাঁধ সংস্কারের পরে, উধাও জলে ভাসমান আগাছা। ফলে, বিষ্ণুপুরের লালবাঁধে শীতকালীন সংসার পাততে গিয়ে সমস্যায় পড়ছে পরিযায়ী পাখিরা।
শীত পড়লেই পরিযায়ী পাখিরা আসে লালবাঁধে। লালবাঁধের জলে ভাসমান আগাছা তাদের অস্থায়ী বাসস্থান। কিন্তু এ বার ছবিটা অন্য রকম। স্থানীয় পক্ষীপ্রেমীদের দাবি, অনেক কম সংখ্যক পরিযায়ী এ বার লালবাঁধে এসেছে। পর্যটকদের কথা ভেবে সম্প্রতি বিষ্ণুপুর মহকুমা প্রশাসন বাঁধের সংস্কার করেছে। ভাসমান আগাছা আর নেই। এখন বাঁধে চলে দু’টি ভুটভুটি। তাতেই সন্ত্রস্ত বাঁধের পাখিরা।
শীতের মরসুমে পিনটেল, গাডওয়ালের মতো পাখি সুদূর সাইবেরিয়া, মঙ্গোলিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জলাশয়ে হাজির হয়। বিষ্ণুপুরের লালবাঁধ, পুরুলিয়ার সাহেববাঁধের মতো জায়গায় সংসার পাতে পরিযায়ীরা। লালবাঁধের বদলে যাওয়া ছবি দেখে অনেক পাখি-ই ফিরে গিয়েছে বলে দাবি পক্ষী বিশেষজ্ঞদের একাংশের।
পক্ষী বিশেষজ্ঞ অনির্বাণ পাত্র মনে করেন, “লালবাঁধ সংস্কারে পরিযায়ীদের ততটা ক্ষতি হয়নি, যতটা হয়েছে বাঁধে যন্ত্রচালিত বোট নামানোয়। এ বছর লালবাঁধে পরিযায়ীদের সংখ্যা কমে প্রায় অর্ধেক হয়ে গিয়েছে। যে সমস্ত পাখি বাঁধে স্থায়ী ভাবে থাকে তারাও আক্রান্ত হচ্ছে প্রতিনিয়ত।’’ তিনি বলেন, ‘‘ভুটভুটির শব্দে আতঙ্কিত পাখিরা। অবিলম্বে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা প্রয়োজন।”
পক্ষীপ্রেমী এবং বিশেষজ্ঞদের দাবির সঙ্গে একমত নয় প্রশাসন। মহকুমাশাসক (বিষ্ণুপুর) মানস মণ্ডলের দাবি, ‘‘লালবাঁধের সংস্কারের ফলে পরিযায়ীদের অসুবিধে হয়নি। বাঁধের এক দিকে ভাসমান আগাছা রেখে দিয়েছি।’’ তিনি এ-ও মনে করেন, ‘‘পাখিরা ভুটভুটির শব্দ মানিয়ে নিয়েছে।’’ পাখিদের কাছে যেতে নিষেধ করা হয়েছে বোট চালকদের। তবু পাখিদের অসুবিধা হচ্ছে কিনা, তা খোঁজ নিয়ে দেখবেন বলে পক্ষী বিশেষজ্ঞদের আশ্বস্ত করেছেন মহকুমাশাসক।
পাখিদের ‘অসুবিধা’র ব্যাপারে সরাসরি হস্তক্ষেপ করার কোনও সুযোগ তাদের নেই বলে জানাচ্ছে বন দফতর। সে ক্ষেত্রে ‘জন-সচেতনতা’ গড়ে তোলাই একমাত্র উপায় বলে মনে করছে তারা। পাঞ্চেত বন বিভাগের ডিএফও নীলরতন পান্ডার কথায় , “এ সব ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ভাবে বনবিভাগ কোনও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারে না। তবে বন্যপ্রাণ বিপন্ন হলে দফতর সক্রিয় হতে পারে। এর জন্য আইনও রয়েছে।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘লালবাঁধের বোট চালকদের উপরে কোনও নিয়ন্ত্রণ জারি করা যায় কি না, তা নিয়ে সকলের সঙ্গে বৈঠক করব।”
প্রত্যেক বছর লালবাঁধে পাখি দেখতে আসে প্রতীক পোছালি, কাজী ওয়াসিম আখতার, পূর্ণেন্দু ধল এবং সুদন লোহারের মতো অনেক পড়ুয়া। তাদের দাবি, ‘‘এ বছর পাখির সংখ্যা অনেক কমে গিয়েছে। স্নানের জন্য মানুষ বাঁধে নামছে। পাখিদের থাকার জায়গা ক্রমে ছোট হচ্ছে। বাঁধ জুড়ে ভুটভুটির শব্দ আর কোলাহলে আতঙ্কিত পরিযায়ীরা এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে উড়ে বেড়াচ্ছে। প্রভাবিত হচ্ছে স্বাভাবিক প্রজনন প্রক্রিয়া।’’ ওই পক্ষীপ্রেমীদের দাবি, ‘‘বাঁধের একটি দিক যাতে নির্জন থাকে, অন্তত তার ব্যবস্থা করুক প্রশাসন।”
বাঁধ সংস্কার হওয়ায় খুশি বিকাশ প্রামাণিক, শঙ্খজিৎ রায়, সজল চক্রবর্তীর মতো স্থানীয় বাসিন্দারা। তবে তাঁরা এ-ও বলছেন , “পরিযায়ীরা বাঁধের ধারেই বাসা বাঁধত। এখন সেখানে মানুষের যাতায়াত বাড়ায় তারা চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। পাখিদের জন্য বাঁধে কী করা যায়, দেখা হোক।”