বর্ষা-পীড়িত: বিষ্ণুপুর ব্লকের বরামারা গ্রামের একটি খেতে রবিবার সকালে। নিজস্ব চিত্র
বর্ষাকালে ভাল বৃষ্টি হয়নি। জল কিনে ধান রুয়েছিলেন। হেমন্তে বৃষ্টি এসে পাকা ধানে মই দিয়ে গেল, খেদ করছিলেন বিষ্ণুপুরের বরামারা গ্রামের সুকুমার পাত্র, বিশ্বনাথ সর্দাররা।
শনিবার রাতে খেতের ধান নুইয়ে, মাচার লাউ ছিঁড়ে বাঁকুড়ার এক প্রান্ত ভিজিয়ে দিয়ে গিয়েছে ‘বুলবুল’। ঝড়ের ঝাপট লাগেনি বটে, কিন্তু ঝোড়ো হাওয়াতেই ক্ষতি হয়েছে ফসলের। শনিবার রাতে ঘূর্ণীঝড় ‘বুলবুল’-এর জেরে বৃষ্টি হয়েছে মূলত বিষ্ণুপুর মহকুমার তিনটি ব্লকে। বাঁকুড়া জেলা কৃষি অধিকর্তা সুশান্ত মহাপাত্র জানান, বেশি বৃষ্টি হয়েছে পাত্রসায়র ব্লকে। ইন্দাস আর বিষ্ণুপুরে কিছুটা করে। এই সমস্ত এলাকায় সুগন্ধী ‘খাস’ ধানের চাষ হয়। সুশান্তবাবু বলেন, ‘‘চিন্তার বিষয়টা হল, খাস ধানের শিষের ৪ থেকে ৬ ইঞ্চি নীচে পচন দেখা যাচ্ছে। এটা আগে এই অঞ্চলে দেখা যায়নি।’’ মরসুমের শেষে একেবারে নতুন রোগ চিন্তায় ফেলেছে চাষিদের। জেলার ছত্রাক-রোগ বিশেষজ্ঞ খুব তাড়াতাড়ি আক্রান্ত খেতগুলি পরিদর্শনে ইন্দাস এবং পাত্রসায়ের যাবেন বলে দফতর থেকে জানানো হয়েছে। এই সময়ে চাষিদের কী করা দরকার আর কী করা উচিত নয়— তা আজ, সোমবার মাইক নিয়ে মহকুমার বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে প্রচার করতে বলা হয়েছে ছ’টি ব্লকের সহ-কৃষি অধিকর্তাদের।
বিষ্ণুপুর মহকুমা কৃষি দফতরের সহ-কৃষি অধিকর্তা (বিষয়বস্তু) অমিতাভ পান্ডে জানান, এই সময়ে ‘খাস’ ধানের মাথাটা ভারী হয়। চাষিরা বলেন, ‘নোয়ানি অবস্থা’। মহকুমার ৪২ হাজার হেক্টর জমিতে এ বার ‘খাস’ ধানের চাষ হয়েছিল। ঝোড়ো হাওয়ায় নুয়ে পড়া ধান থেকে ফসল কম মিলতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকে। খরিফ মরসুমে বিষ্ণুপুরের মোট ২ লক্ষ ৬ হাজার হেক্টর জমিতে ধান চাষ হয়েছিল। অনেক চাষিই ধান কাটলেও ঘরে তুলে নিতে পারেননি। বৃষ্টিতে মাঠেই পড়ে পড়ে ভিজেছে সেই ধান। বিষ্ণুপুর ব্লকের বরামারা গ্রামের প্রবীণ চাষি হারাধন সর্দার রবিবার সকালে জমিতে কেটে রাখা ধান গুছিয়ে রাখছিলেন। তিনি বলেন, ‘‘রেডিয়োয় বলেছিল। তার পরেও ধানটা কেটে বড় বিপাকে পড়লাম।’’
ইন্দাস ব্লকের দেবাশিস চট্টোপাধ্যায়, অনাথ গুহ, পাত্রসায়রের চণ্ডীচরণ চট্টোপাধ্যায়, গুরুদাস ঘোষেরা জানান, খাস ধানের ক্ষতি তো হয়েছেই, পিছিয়ে গিয়েছে জলদি আলু লাগানোর কাজও। সুশান্তবাবু জানাচ্ছেন, বুলবুলের জেরে বাজারে আলুর দামও বাড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এখন জেলার ৪৬টি হিমঘরে ১৬ লক্ষ টন আলু রয়েছে। পরিমানে তা খুব বেশি নয়। সুশান্তবাবু বলেন, ‘‘আমাদের কাছে খবর আছে, ভিন্ রাজ্যেও আলু যাচ্ছে। এ দিকে দুর্গা পুজোর সময়ে বৃষ্টি, বুলবুলের প্রভাবে এখনকার বৃষ্টি— সব মিলিয়ে জলদি আলু চাষে বাধা পড়েছে। পিছিয়ে যাচ্ছে জলদি আলুর বাজারে আসার সময়। ফলে আলুর দাম বাড়ার সম্ভবনা রয়েছে।’’ তিনি জানান, ডালশস্য, তৈলবীজ চাষও পিছিয়ে যাবে এই বৃষ্টির জেরে।
শনিবারের রাতের বৃষ্টিতে মুখ শুকিয়েছে বাঁকাদহ পঞ্চায়েতের কলাবাগানের চাষি আলিপ মোল্লা, কুতুবুদ্দিন চৌধুরী, মকবুল দালালদের। পশ্চিম মেদিনীপুর লাগোয়া কলাবাগান হাতির করিডোর নামে পরিচিত। তিন বছর এ পথে হাতির দল আসছে না। স্বস্তিতেই আনাজ চাষ করেছিলেন ওই গ্রামের চাষিরা। আলিপ মোল্লা রবিবার সকালে ভেঙে পড়া লাউয়ের মাচা মেরামতের ফাঁকে বলেন, ‘‘আশ্বিনের গোড়াই ১২ কাঠা জমিতে ৭ হাজার টাকা খরচা করেছিলাম। এক রাতের ঝোড়ো হাওয়া আর টানা বৃষ্টি লাউ খেতের দফারফা করে দিল। এক রাতেই প্রায় ২০০টা লাউ নষ্ট হয়েছে। বাজারে এক-একটার দাম ২২ টাকা করে।’’ কুতুবুদ্দিন জানান, জল জমে ক্ষতি হয়েছে শাঁকালু, বেগুন, বরবটিরও। জনতা, লয়ার, বসন্তপুরের মতো যে সমস্ত গ্রামে আনাজ চাষ বেশি হয়, সেখানে তিনি পরিদর্শনে যাবেন বলে জানিয়েছেন অমিতাভবাবু।
বিষ্ণুপুরের ঢ্যাঙাশোলের রতন মিদ্যা, স্বপন ডাল, প্রশান্ত দাস, রাজপুরের রাজু খান, হাসমত গাজিদের অবশ্য এই বৃষ্টি এক প্রকার কাজে এসেছে। টোম্যাটো চাষ করেছেন তাঁরা। সদ্য ফলন দেখা দিয়েছে। প্রতি ঘণ্টায় ১৪০ টাকা খরচ করে সেচ দিতে হচ্ছিল। রতন, রাজুরা বলেন, ‘‘এই সময়টায় জল লাগে। দুটো পাওনি বাঁচিয়ে দিল।’’ তবে জলের দোসর হাওয়া গাছের ফুল ঝরিয়ে যা ক্ষতি করেছে, তার তুলনায় এই লাভ কতটা— সেই হিসেব এখন কষতে হচ্ছে তাঁদের।