ওজন করা হচ্ছে। নিজস্ব চিত্র
খাওয়ার ব্যাপারে বড্ড অরুচি। আর তার জেরেই অপুষ্ট থেকে যাচ্ছে তাঁদের শিশুরা। বাঁকুড়ার জঙ্গলমহল রানিবাঁধের একটি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে এমনই দাবি করলেন তিন অপুষ্ট শিশুর মায়েরা। এ দিকে, শুক্রবার রানিবাঁধ ব্লকে উন্নয়ন বৈঠকে ৬০ জন অপুষ্ট শিশুর কথা শুনে প্রকাশ্যেই উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন বাঁকুড়ার জেলাশাসক উমাশঙ্কর এস। সোমবারে পাওয়া পরিসংখ্যান বলছে, অক্টোবরে করা শেষ হিসাব অনুযায়ী, রানিবাঁধ ব্লকে অপুষ্ট শিশুর সংখ্যা ৮৮ জন। এখানেই প্রশাসন এবং স্বাস্থ্য দফতরের আধিকারিকদের কেউ কেউ মনে করছেন, অপুষ্টির নেপথ্যে সচেতনতার অভাবও অন্যতম কারণ।
উন্নয়ন বৈঠকে ছিলেন জেলা পরিষদের সভাধিপতি মৃত্যুঞ্জয় মুর্মু ও সহ-সভাধিপতি শুভাশিস বটব্যাল। মৃত্যুঞ্জয়বাবু বলেন, ‘‘আমাদের সরকার জঙ্গলমহল এলাকার উন্নয়নের জন্য প্রচুর চেষ্টা করছে। তার পরেও জঙ্গলমহল এলাকার শিশুরা অপুষ্টিতে ভুগছে, এটা খুব দুঃখজনক ঘটনা। তাদের স্বাভাবিক শারীরিক বৃদ্ধির জন্য আমার এবং সহ-সভাধিপতির সম্মানিকের টাকার পুরোটাই পুষ্টিকর খাবারের জন্য দেওয়া হবে বিডিওদের মাধ্যমে। পুষ্টিকর খাবার কিনে সিডিপিও-র মাধ্যমে পরিবারগুলির হাতে তুলে দেওয়া হবে।’’ বিডিও (রানিবাঁধ) শুভদীপ পালিত বলেন, ‘‘অপুষ্ট শিশুদের উপরে নজর রাখতে বলা হয়েছে আইসিডিএস কর্মীদের। আলাদা টাকা এলে সেইমতো পুষ্টিকর খাবার কিনে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।’’
কিন্তু পুষ্টিকর খাবার হাতে থাকলেই যে শিশুর পুষ্টি নিশ্চিত হবে— বিষয়টা এতটা সরল নয় বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য দফতরের কোনও কোনও আধিকারিক। ব্লক সুসংহত শিশু বিকাশ প্রকল্প আধিকারিকের দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, রানিবাঁধের আটটি পঞ্চায়েত এলাকায় ৩৪২টি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র রয়েছে। প্রতিটি পঞ্চায়েত এলাকাতেই কম-বেশি অপুষ্ট শিশু রয়েছে। সোমবার রাজাকাজা পঞ্চায়েত এলাকায় রানিবাঁধে কেলিয়াপাথর অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে তিন জন অপুষ্ট শিশুকে দেখা গেল। মায়েরা তাদের নিয়ে এসেছিলেন। এক জনের বয়স চার বছর, এক জনের তিন বছর সাত মাস, অন্য জনেরএক বছর সাত মাস। সবাই দিনমজুর পরিবারের। চার বছরের শিশুটির মা জানান, সারেঙ্গার নার্সিংহোমে তাঁর মেয়ের জন্ম হয়। জন্মের সময় ওজন ছিল আড়াই কেজি মতো। তাঁর কথায়, ‘‘একটু বড় হতেই খাওয়ার প্রতি ঝোঁক কমে যায়। আইসিডিএস সেন্টারে নিয়ে এলে ভুলিয়েভালিয়ে কোনও রকমে খাওয়ানো হয়।’’ বাড়িতে কিছুতেই দুধ খাওয়ানো যায় না। স্বাদু ‘হেলথ ড্রিঙ্ক’ মিশিয়েও নয়। অঙ্গনওয়াড়িতে যে ছাতু দেওয়া হয়, সেটা অবশ্য খেয়ে নেয়। ওই এক খাবারে অনিচ্ছা ছাড়া, আর সমস্ত কিছুই স্বাভাবিক শিশুটির।
একই বক্তব্য তিন বছর সাত মাসের শিশুটির মায়েরও। রানিবাঁধ ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রেই তাঁর ছেলের জন্ম হয়। ছোট থেকেই খাবার প্রতি অনীহা। মায়ের কথায়, ‘‘সেন্টারে এলে তবু আর পাঁচটা বাচ্চাকে দেখে একটু-আধটু খায়।’’ ওই অঙ্গনওয়াড়ির কর্মী ললিতা মাহাতো জানান, মোট ৩৮ জন শিশু রয়েছে ওই কেন্দ্রে। গর্ভবতী মা রয়েছেন তিন জন। শিশুদের মধ্যে তিন জনের ওজন স্বাভাবিকের থেকে কম। ওই দুই শিশুর এখন ওজন প্রায় ১১ কিলোগ্রাম। দু’জনেরই আরও প্রায় ৫০০ গ্রাম ওজন বেশি হওয়া দরকার।
সিডিপিও (রানিবাঁধ) মৃদুল চক্রবর্তী জানান, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে অপুষ্ট শিশুদের অন্য খাবারের সঙ্গে ছাতু দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। তার পরেও যদি কাজ না হয়, তা হলে তাদের পাঠানো হয় রানিবাঁধে, পুষ্টি পুনর্বাসন কেন্দ্রে। বিএমওএইচ (রানিবাঁধ) অরূপকুমার পণ্ডা জানান, প্রতি মাসে শিবির করে শিশুদের পরীক্ষা করা হয়। সেখানেই দরকার মতো পুষ্টি পুনর্বাসন কেন্দ্রে পাঠানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। কেন্দ্রে রয়েছে ১০টি শয্যা। মা-সহ শিশুকে এক মাস রেখে বিভিন্ন ধরনের পুষ্টিকর খাবার খাওয়া ও খাওয়ানো রপ্ত করানো হয়।
পুরুলিয়ার প্রাক্তন জেলা মাতৃত্ব ও শিশুস্বাস্থ্য আধিকারিক আজিজুর রহমানের অভিজ্ঞতা বলছে, অনেক ক্ষেত্রে শিশুকে বড় করে তোলার ব্যাপারে অজান্তেই ‘খামতি’ থেকে যায় পরিবারের। তিনি বলেন, ‘‘চাল-ডাল-চিঁড়ে আর গুড় দিয়ে যে স্বাস্থ্যকর ভাল খাবার বানানো যায়, সেটাই অনেক বাবা-মাকে বুঝিয়ে পারা যায় না। তাঁরা চান তৈরি কিছু। জাদুর মতো কাজ করবে। বিজ্ঞাপনের মতো।’’
জেলার একটি পুষ্টি পুনর্বাসন কেন্দ্রের কর্মীরা জানাচ্ছেন, সেখানে যে ছাতুটা দেওয়া হয় অপুষ্ট শিশুদের, তা মাখার সময়ে ক’ফোঁটা নারকেল তেল দিয়ে দেন। শিশুরা পছন্দ করে। বাঁকুড়ার জেলাশাসক উমাশঙ্কর এস জানান, ঠিক ভাবে খাবার যাতে শিশুরা খেতে শেখে সে জন্য স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলিকে কাজে লাগানোর ভাবনা রয়েছে তাঁদের। জেলাশাসক বলেন, ‘‘স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলাদের দিয়ে নিয়মিত যোগাযোগ রাখার কথা ভাবা হচ্ছে। শিশুরা যে খাবার পাবে, তা যাতে তারা ঠিকমতো খায় সেটা নিশ্চিত করবেন তাঁরা।’’