বাঁকুড়া আদালতে আসামি। বুধবার। নিজস্ব চিত্র
দ্বিতীয়বার কন্যা সন্তান হওয়ায় ১৬ দিনের মেয়েকে খুন করে জমিতে পুঁতে দিয়েছিল বাবা। বছর তিনেক আগের সেই ঘটনায় বুধবার নিহতের বাবার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিল বাঁকুড়ার জেলা জজ মনোজ্যোতি ভট্টাচার্য। সাজাপ্রাপ্তের নাম অসিনাথ সরেন।ছাতনার তুলসা গ্রামে তার বাড়ি।
সরকার পক্ষের আইনজীবী রথীন দে জানান, অসিনাথ সরেন ও সোহাগি সরেনের প্রথমে একটি কন্যা সন্তান হয়। এর আড়াই বছর পরে (২০২১ সালে) ফের তাঁদের একটি মেয়ে হয়। এতে প্রথম থেকেই খুশি ছিল না অসিনাথ। এ জন্য স্ত্রীর কাছে বার বার আক্ষেপও করে সে। ঘটনার দিন ২০২১ সালের ৯ অক্টোবর বিকেলে সোহাগি তাঁর বড় মেয়েকে নিয়ে শৌচকর্মে গিয়েছিলেন। বাড়িতে অসিনাথের কাছে ছিল ১৬ দিনের মেয়ে। সোহাগি বাড়ি ফিরে দেখে তাঁর ছোটো মেয়ে নেই। অসিনাথকে বার বার জিজ্ঞাসা করেও কোনও জবাব পায়নি। বরং সোহাগিকেই ভয় দেখিয়ে ঘরবন্দি করে রেখে দেয় সে।
ঘটনার আট দিন পরে ১৭ অক্টোবর সোহাগি কোনও ভাবে তাঁর বাবাকে ফোন করে শ্বশুরবাড়িতে ডেকে পাঠান। সে দিনই লোকজন জড়ো করে সোহাগির বাবা পুরুলিয়ার কাশীপুর থানা এলাকার বাসিন্দা লক্ষ্মণচন্দ্র টুডু তুলসা গ্রামে হাজির হন। লক্ষ্মণচন্দ্র মেয়ে ও বড় নাতনিকে নিয়ে কাশীপুরে ফিরে যান। বাপের বাড়িতে সব কথা খুলে বলেন সোহাগি। পরের দিন ১৮ অক্টোবর সোহাগি বাবাকে নিয়ে ছাতনা থানায় গিয়ে স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন।
পুলিশ অভিযোগ পেয়েই অসিনাথকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। পুলিশের কাছে অসিনাথ ছোটো মেয়েকে খুনের কথা স্বীকার করে। ২০ অক্টোবর ঘটনার পুনর্নিমাণ করে পুলিশ। ধৃতের কথা মতো তুলসার পাশের গ্রাম পড়াশিয়ার একটি ধানজমির মাটি খুঁড়ে ওই শিশুর দেহ উদ্ধার করে পুলিশ। অসিনাথ পুলিশকে জানিয়েছিল, সোহাগি বড় মেয়েকে নিয়ে বাইরে যেতেই প্রথমে বাড়ির কুয়োয় ছোট মেয়েকে ফেলে দেয়। দেহ ভেসে ওঠার পরে তুলে নিয়ে পড়াশিয়ার ধানজমিতে সে পুঁতে দেয়।
২০২১ সালের ২২ ডিসেম্বর তদন্ত করে বাঁকুড়া আদালতে চার্জশিট জমা দেয় পুলিশ। গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে আর জামিন পায়নি অসিনাথ। মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ পর্ব শুরু হয়। রথীন বলেন, ‘‘মোট ১৬ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। তদন্ত ও বিচারপর্বে আসামির স্ত্রী সোহাগি পূর্ণ সহযোগিতা করেন। সমস্ত সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে বিচারক অসিনাথকে দোষী সাব্যস্ত করে খুন ও দেহ লোপাটের মামলায় সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে আরও ছ’মাস জেল হেফাজতের নির্দেশ দেন।’’
এ দিন আদালতে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন সোহাগি। সরকারি আইনজীবীর অফিসে বসেই তিনি বলেন, “পর পর দু’টি মেয়ে হওয়ায় স্বামী অখুশি ছিল। আমাকে প্রায়ই গঞ্জনা করত। কিন্তু সে যে ছোট মেয়েকে খুন করে দিতে পারে, কল্পনাও করিনি। তাহলে কোনও দিন ওকে একা রেখে আমি যেতাম না। যে ভাবেই হোক এই কাজের জন্য যাতে সে শাস্তি পায়, সেটাই চেষ্টা করে গিয়েছি। আজ আমার ছোট মেয়ের খুনের বিচার পেয়ে কিছুটা স্বস্তি পেয়েছি।”
আইনজীবী রথীন বলেন, “ঘটনাটি খুবই স্পর্শকাতর। কোনও ভাবেই যাতে অভিযুক্ত ব্যক্তি জামিন না পায় সেই চেষ্টা প্রথম থেকেই করে গিয়েছি। মামলাটির দ্রুত নিষ্পত্তিও হয়েছে। সমাজের কাছেও এটি একটি বার্তা।”