জেলা স্কুলের মাঠে অবস্থানে বামেরা। —নিজস্ব চিত্র
পুলিশ-প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে কোথাও হুমকি, কোথাও টোপ— বিরোধী দলের নির্বাচিত সদস্যদের এ ভাবেই উল্টো দিকে দিকে টেনে একে একে দখল করা হচ্ছে পঞ্চায়েত থেকে জেলা পরিষদ।
রাজ্যে ক্ষমতাসীন তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে এমনই অভিযোগ তুলে সোমবার যখন জেলা সদর সিউড়িতে অবস্থান বিক্ষোভ করছেন বাম নেতৃত্ব, ঠিক তখনই হাতছাড়া হয়ে গেল রাজনগরে বামেদের দখলে থাকা একমাত্র পঞ্চায়েতটিও। দিন কয়েক আগেই বাম পরিচালিত ওই পঞ্চায়েতের সিপিএম সদস্য উপপ্রধানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব জমা পড়েছিল। রাজনগরের বিডিও দীনেশ মিশ্র বলেন, ‘‘যুগ্ম বিডিও অভিষেক রায়ের উপস্থিতিতে এ দিনের তলবি সভায় উপপ্রধানের বিরুদ্ধে অনাস্থা পাশ হয়ে গিয়েছে।’’
তৃণমূল সূত্রের খবর, গত ভোটে রাজনগর ব্লকের পাঁচটির মধ্যে শুধুমাত্র ১১ আসন বিশিষ্ট গামুড়ি–জয়পুর পঞ্চায়েতের দখল নিতে ব্যর্থ হয়েছিল তৃণমূল। সিপিএম ৭টি আসন পেয়ে ওই পঞ্চায়েতের ক্ষমতা দখল করেছিল। তৃণমূল পায় ৪টি আসন। সেটাই কোথাও যেন কাঁটার মতো বিঁধছিল এলাকার তৃণমূল নেতৃত্বের। কিন্তু সমস্যা মেটাতে প্রধান অন্তরায় ছিল দলেরই অন্দরের কোন্দল। স্থানীয় এক নেতার সঙ্গে ব্লকের তৃণমূলের শেষ কথা তথা পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি সুকুমার সাধুর প্রবল মতবিরোধের জায়গা তৈরি হয়েছিল বলে এলাকার তৃণমূল কর্মীদের দাবি। তবে, গেল বিধানসভা ভোটের পরে তৃণমূলের বিপুল সাফল্যের পরে সেই বিরোধ মিটে যায়। তখন থেকেই পঞ্চায়েত দখলের জন্য চেষ্টা চালাচ্ছিল তৃণমূল।
দিন পনেরো আগে সিপিএম প্রধান সোনালি গড়াই এবং আর এক বাম সদস্য প্রদীপ দাসকে নিজেদের দলে টানতে সক্ষম হয় তৃণমূল। ক্ষমতার নতুন সমীকরণ তৃণমূলের পক্ষে ৬-৫ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু প্রধান যতই শাসকদলের হোন, উপপ্রধান সিপিএমের জাহের মিঁয়া দল ছাড়েননি। ফলে পঞ্চায়েত দখল করেও উপপ্রধান বিরোধী দলের থাকবেন, সেটাই কোথাও মানতে পারছিল না তৃণমূল। তাই জাহেরের বিরুদ্ধে আনাস্থা নিয়ে আসে তৃণমূল। সেই প্রস্তাবে সই করেন চার তৃণমূল সদস্য ছাড়াও মৌখিক ভাবে তৃণমূলে যোগ দেওয়া প্রধান এবং প্রদীপবাবু। সে দিনই ছবিটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এ দিন শুধু আনুষ্ঠানিকতাটুকুই বাকি ছিল। উপপ্রধান-সহ পাঁচ বাম সদস্যের কেউ-ই এ দিনের আস্থা ভোটে উপস্থিত ছিলেন না। অনাস্থার প্রস্তাব পাশ হয়ে যায় ৬-০ ব্যবধানে।
কেন এই দল বদল?
মারাত্মক দাবি করেছেন এ দিনই আনুষ্ঠানিক ভাবে তৃণমূলে যোগ দেওয়া সোনালিদেবী। তাঁর বক্তব্য, ‘‘পঞ্চায়েতের প্রতিটি পদক্ষেপে সমস্যা হচ্ছিল। তা মেটাতে তৃণমূল নেতৃত্বের দারস্থ হতে হতো। এ ভাবে আর পঞ্চায়েত চালানো যাচ্ছিল না। তাই দল বদল করলাম।’’ অন্য দিকে, জাহেরের দাবি, ‘‘আমাকে হঠানোর জন্যই এত নাটক!’’ প্রধানের ওই বক্তব্যকে লুফে নিয়েই বাম নেতৃত্বের অভিযোগ, শাসকদল রাজ্যে গণতন্ত্র-বিরোধী পরিবেশ তৈরি করেছে। গামুড়ি–জয়পুরের মতো নির্বাচিত সদস্যদের দিয়ে গঠিত পঞ্চায়েতকে তারা কোনও উন্নয়নের কাজ করতে দিচ্ছে না। কারণ সেগুলি বিরোধীরা চালাচ্ছেন। সোনালিদেবীদের তৃণমূলের নেতাদের দ্বারস্থ হওয়ার মধ্য দিয়েই ওই অভিযোগ প্রমাণিত হয় বলে জেলা বাম নেতৃত্বের দাবি। সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রামচন্দ্র ডোমের কথায়, ‘‘এটা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। রাজ্যের সর্বত্রই এক জিনিস চলছে। যেন তেন প্রকারে বিরোধী নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দলে টেনে বিরোধী-শূন্য করা। এটা গণতন্ত্রকে হত্যা করার সামিল। এটা যে মানুষগুলো ভোট দিয়ে নির্বাচিত করছেন, তাঁদের রায়কেও অপমান করা।’’ তাঁর অভিযোগ, রাজ্যের সর্বত্র সরকারি টাকার অবাধ লুঠপাটই তৃণমূলের প্রকৃত উদ্দেশ্য।
তারই প্রতিবাদে এ দিন সিউড়িতে প্রশাসন ভবনের সামনে জেলাস্কুলের মাঠে পঞ্চায়েতের তিন স্তরের নির্বাচিত বর্তমান ও প্রাক্তন জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে অবস্থান বিক্ষোভ করে বামেরা। ওই কর্মসূচিতে রামচন্দ্র ডোম ছড়াও সিপিএমের জেলা সম্পাদক মনসা হাঁসদা, নানুরের সিপিএম বিধায়ক শ্যামলী প্রধান উপস্থিত ছিলেন। পরে জেলাশাসককে একটি স্মারকলিপিও দেন বাম নেতৃত্ব। জেলাশাসক পি মোহন গাঁধীর পরিবর্তে স্মরকলিপি নেন অতিরিক্ত জেলাশাসক (উন্নয়ন) রঞ্জনকুমার ঝা।
বামেদের আনা অভিযোগ মানতে নারাজ তৃণমূল নেতৃত্ব। রাজনগর পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি তথা তৃণমূল নেতা সুকুমার সাধুর দাবি, ‘‘জোর করা বা ভয় দেখানোর প্রশ্নই নেই। বিরোধী দলগুলি জমি হারিয়ে এ সব বিভ্রান্তিকর কথা বলছে। আসলে উন্নয়নে সামিল হতেই প্রধান-সহ সিপিএমের ওই দুই সদস্য আমাদের দলে নাম লিখিয়েছেন।’’