ধুলিসাৎ। হাইকোর্টের নির্দেশে ঐতিহ্যবাহী এডওয়ার্ড হলের জায়গা দখল করে তৈরি হওয়া কো-অর্ডিনেশন কমিটির জেলা অফিস ভেঙে দিল প্রশাসন। শুক্রবার অভিজিৎ সিংহের তোলা ছবি।
হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছিল সাড়ে তিন বছর আগে। কিন্তু প্রশাসন নামছিল না। অবশেষে শুক্রবার বাঁকুড়ার ঐতিহ্যবাহী এডওয়ার্ড হলের জমি দখল করে থাকা বামপন্থী কর্মচারী সংগঠন কো-অর্ডিনেশন কমিটির জেলা অফিসের একাংশ ভেঙে দিল প্রশাসন।
এ দিন সকালে জেলাশাসক মৌমিতা গোদারা বসু, অতিরিক্ত জেলাশাসক (ভূমি ও ভূমি সংস্কার) পার্থ ঘোষ ও বাঁকুড়া সদর মহকুমাশাসক অসীমকুমার বালার উপস্থিতিতে মেশিন দিয়ে তিনতলার ভবনের দখল করা অংশ ভাঙার কাজ শুরু হয়। প্রচুর লোকজনও ভিড় করেন। পুলিশ ভিড় সামলাতে নাকাল হয়। দুপুর পর্যন্ত চলে ভাঙাচোরার কাজ। তবে কাজে বাধা আসেনি। এলাকায় বামপন্থী নেতাদের সে ভাবে দেখা যায়নি।
প্রশাসনিক সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১৬-র ২০ ডিসেম্বরের মধ্যে কো-অর্ডিনেশন কমিটিকে অবৈধ অংশ ভেঙে ফেলতে নির্দেশ দিয়েছিলেন মহকুমাশাসক (বাঁকুড়া সদর)। তা চ্যালেঞ্জ করে ওই কর্মচারী সমিতি আদালতে যায়। যদিও আদালত ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যেই ওই নির্মাণের বেআইনি অংশ ভেঙে দেওয়ার নির্দিষ্ট দিন ধার্য করে দেয়। জেলাশাসক ও ভূমি দফতরের অতিরিক্ত জেলাশাসককে আলাদা ভাবে এফিডেভিট করে আদালতের নির্দেশ মানা হয়েছে, কি না তা জানাতে বলা হয়।
জেলাশাসক বলেন, ‘‘আদালত এ মাসের মধ্যে ওই ভবনের বেআইনি অংশ ভাঙতে নির্দেশ দিয়েছিল। নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যেই তা ভাঙা হল।’’ প্রশাসন সূত্রের খবর, ২০১৫ সালেই সরকারি জমি ওই ভবনকে দেওয়ার লিজের মেয়াদও শেষ হয়ে গিয়েছিল। কো-অর্ডিনেশন কমিটির তরফে এ ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করতে চাওয়া হয়নি। সিপিএমের জেলা সম্পাদক অজিত পতির মন্তব্য, ‘‘বর্তমানের সরকারের কাজই হল শুধু ভাঙা। গড়তে ওরা শেখেনি।’’
১৯১১ সালে অ্যালবার্ট এডওয়ার্ডের স্মরণে এই সভাঘর তৈরি করা হয়। সেই সময়ে গুণীজন সংবর্ধনা থেকে নানা অনুষ্ঠান এখানেই হতো। এই সভাঘর তখন কার্যত বাঁকুড়ার টাউন হল হয়ে উঠেছিল। ইতিহাস বলছে, ইন্দিরা গাঁধী, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, বিজ্ঞানী প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের মতো ব্যক্তিত্ব এই সভাঘরে এসেছেন। রামকিঙ্কর বেইজের চিত্র প্রদর্শনীও হয় এখানেই। কিন্তু আশির দশক থেকে হলটি সাধারণ মানুষের জন্য বন্ধ হয়ে যায়।
দীর্ঘদিন ধরে সংস্কারের অভাবে জীর্ণ হয়ে কালের গর্ভে যেতে বসেছিল এডওয়ার্ড হল। জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়ার দাবিতে ২০০৬ সাল থেকে আন্দোলন শুরু করেন বাঁকুড়ার সংস্কৃতি প্রেমী মানুষ। তাঁদের দাবি মেনে, ২০০৯ সালে এই হলটিকে ‘ঐতিহ্যবাহী ভবন’-এর স্বীকৃতি দেয় রাজ্য হেরিটেজ কমিশন। হলটির সংস্কারও হয়। কিন্তু জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়নি।
হলের চারপাশের দখলদারি নিয়েও অসন্তুষ্ট ছিল দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসা বাঁকুড়া শাস্ত্রীয় সঙ্গীত সমাজ। বাঁকুড়া মৌজায় সাবেক ৮৪৪ দাগে ওই সভাগৃহের জায়গা হিসেবে ০.৩৫৫ একর জমি চিহ্নিত ছিল। পরবর্তী কালে ২০০৮ সালে সমীক্ষা করতে নেমে প্রশাসন দেখে, বাস্তবে সভাগৃহের জমির পরিমাণ কমে হয়েছে ০.১৪২৪ একর। বাকি জায়গা কোথায় গেল? ১৯৮৫ সালে ৩০ বছরের জন্য এডওয়ার্ড হলের দক্ষিণ দিকের ১৯৬০ বর্গ ফুট জমি কো-অর্ডিনেশন কমিটিকে ‘লিজ’ দিয়েছিল জেলা প্রশাসন। অন্য দিকে হলের উত্তর দিকের বেশ কিছুটা জমিও বাঁকুড়া পুরসভা দখল করে কিছু নির্মাণ করে বলে অভিযোগ। কিন্তু প্রশাসনকে জানিয়েও দখলমুক্ত করা যায়নি। শেষে ২০১২ সালে হলের দু’পাশের দখল হয়ে থাকা জমি উদ্ধার করে হলটি ব্যবহার করার উপযুক্ত পরিকাঠামো গড়ে সাধারণের জন্য খুলে দেওয়ার দাবিতে, হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করে বাঁকুড়া শাস্ত্রীয় সঙ্গীত সমাজ এবং ওই সংগঠনের সম্পাদক জয়দীপ মুখোপাধ্যায়।
তাঁদের পক্ষে আইনজীবী রঘুনাথ চক্রবর্তী শুক্রবার বলেন, ‘‘২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে হাইকোর্টে হলফনামায় জেলাশাসক জানিয়েছিলেন, এডওয়ার্ড হলের উত্তর ও দক্ষিণে অবৈধ নির্মাণ রয়েছে। এর প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট অন্তবর্তী আদেশ দেয়, ওই হলের জায়গা দখলমুক্ত করতে হবে। কিন্তু এতদিন পরে প্রশাসন কো-অর্ডিনেশন কমিটির অফিসের একাংশ ভাঙলেও পুরসভার দখল করা অংশ ভাঙেনি।’’ জয়দীপবাবুর মন্তব্য, ‘‘হাইকোর্টের নির্দেশ পাওয়ার পরেও সরকারের জায়গা দখলমুক্ত করতেই প্রশাসনের সাড়ে চারবছর কেটে গেল! দেখা যাক, বাকি অংশ কবে দখলমুক্ত করা যায়।’’ যদিও মহকুমাশাসকের দাবি, ‘‘এডওয়ার্ড হলের যতটুকু অংশ বেদখল হয়ে ছিল, ততটুকুই ভাঙা হয়েছে।’’
ভাঙচুর করলেই হবে না, এডওয়ার্ড হল কবে ফের আগের চেহারায় সংস্কৃতির পীঠস্থান হয়ে উঠবে, সেটাই দেখতে অধীর জেলার সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষজন।