তিন রাস্তার মোড়ে ক্ষুদিরাম পার্ককেই শহরের মুখ করার দাবি বাসিন্দাদের। উদ্যোগী পুরসভাও। কিন্তু হতশ্রী পার্কের চেহারা কি বদলাবে?—নিজস্ব চিত্র।
শহরের মুখ কোনটা?.
শতাব্দী প্রাচীন শহর রঘুনাথপুরে এই প্রশ্নের উত্তরটাই খুঁজছেন বাসিন্দারা। উত্তরটা পাওয়া কঠিন। কিন্তু অনেকেরই মতে শহরের কার্যত প্রাণকেন্দ্রে পুরভবনের সামনে তিনটি গুরত্বপূর্ণ রাস্তার সংযোগস্থলে থানা ও আদালতের অদূরেই ক্ষুদিরাম পার্ককে শহরের মুখ হিসাবে তুলে ধরতেই পারত পুরসভা। কিন্তু পুরবাসীর আক্ষেপ, পুরবোর্ডের ক্ষমতায় থাকা বাম বা ডান কোনওদলই সেই উদ্যোগ নেয়নি।
বস্তুত যে কোনও শহরের একটা মুখ থাকে, যার সাথে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে থাকে সেই শহর। যেমন আদ্রার মুখ রেলওয়ে বুকিং কাউন্টারের সামনে নেতাজি মূর্তি, পুরুলিয়ার ট্যাক্সিস্ট্যান্ড, বাঁকুড়ার মাচানতলা। রঘুনাথপুরে এখনও পর্যন্ত সেই অর্থে তেমন কিছু উল্লেখ করার মতো নেই। পুরবাসীর অক্ষেপ, রঘুনাথপুরে এই বিষয়টি প্রথম থেকেই অবহেলিত থেকে গিয়েছে। শহরের বাসিন্দাদের অনেকের মতে, অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এলাকা তথা প্রাণকেন্দ্র বলা যায়, ১ নম্বর ওয়ার্ডের এই পার্ক। রঘুনাথপুর-চেলিয়ামা ও রঘুনাথপুর-বাঁকুড়া এবং পুরুলিয়া-বরাকর রাজ্য সড়কের সংযোগস্থলে অবস্থিত এই ক্ষুদিরাম পার্ক। কাছেই রয়েছে পুরভবন, থানা ও আদালত। এই যুক্তিতে বাসিন্দাদের দাবি, ওই পার্কই শহরের মুখ হিসেবে তুলে ধরার আদর্শ জায়গা।
কিন্তু চারকোণা পার্কের ভিতরে শহিদ শহীদ ক্ষুদিরামের যে মূর্তিটি রয়েছে, তা নিতান্তই ছোট। পার্কের অবস্থাও রীতিমতো শোচনীয়। বাইরের দিকে বাঁকুড়া রাস্তার পাশে পার্কের দেওয়াল ঘেঁষে আবর্জনার স্তূপ। বরাকর রাস্তার দিকে খোলা নর্দমা। বর্ষার সময়ে সেই নর্দমার জল উপচে পড়ে রাস্তায়। আর পার্কের মধ্যে মূর্তির নীচে জমে থাকে ঘুঁটে। সব মিলিয়ে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হওয়া স্বত্বেও বরাবরই অবহেলিত রয়ে গেছে পার্কটি। বছরের মধ্যে একবার ক্ষুদিরাম স্মৃতি রক্ষা কমিটির উদ্যোগে শহিদের মৃত্যুর দিনে ১১ অগস্ট একটা অনুষ্ঠান হয়। সে দিনই কমিটির উদ্যোগেই পার্কটির হাল কিছুটা ফেরানো হয়। বছরের বাকি দিনগুলি অবহেলায় থাকে পার্ক।
কমবেশি ২৫-২৬ বছর আগে ওই কমিটি এই পার্ক গড়ে তুলেছিল। কমিটির উদ্যোগে বসানো হয়েছিল ক্ষুদিরামের ছোট আবক্ষ মূর্তি। সেই সময়ে প্রশাসন থেকে মূর্তির চারদিকে পাঁচিল তুলে দেয়। পরে একটি সংস্থার আর্থিক সাহায্যে ক্ষুদিরামের আবক্ষ মূর্তির বদলে ছোট মাপের পূর্ণ একটি মূর্তি বসানো হয়। কাজ শুধু এতটুকুই।
বস্তুত শহরের মুখ হিসাবে এই পার্কটিকে গড়ে তুলতে পুরসভা উদাসীন হওয়ায় বাসিন্দাদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে যথেষ্ট। স্মৃতি রক্ষা কমিটি বা শহরের বিবেকানন্দ পাঠচক্র দু’টি সংগঠন একাধিকবার এই পার্কের সংস্কার করে তা সাজিয়ে তোলার আবেদন জানিয়েছে তৃণমূল পরিচালিত বিগত পুরবোর্ডের কাছে। পাঠচক্রের অন্যতম সদস্য অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা সাধনা সরকার, শিক্ষক কৌশিক সরকাররা বলেন, ‘‘শহরের প্রাণকেন্দ্রে থানা, পুরসভা, আদালতের সামনে থাকা পার্কটির বেহাল দশা দেখে খুব খারাপ লাগে। জনপ্রতিনিধিরা সবাই পার্কের হতশ্রী চেহারা দেখছেন। কিন্তু আশ্চর্য লাগে পার্কটিকে সাজিয়ে তুলতে কেউ কখনই নজর দেননি।” পার্কটিকে নতুন ভাবে গড়ে শহরের মুখ হিসাবে সেটিকে তুলে ধরা যেত বলেই মত শহরের বিশিষ্ট বাসিন্দা সাধনা সরকার, আইনজীবী অলোককুমার নন্দী বা সমাজকর্মী কালাচাঁদ চট্টোপাধ্যায়দের। তাঁদের কথায়, ‘‘শহরের মুখ বলতে কিছুই নেই রঘুনাথপুরে। অথচ স্নায়ুকেন্দ্রে রয়েছে পার্কটি। ফলে এটির আমূল সংস্কার করে আলোর ব্যবস্থা করে সুন্দর ভাবে সাজাতে পারলে শহরের মুখ হিসাবে পার্কটি গড়ে উঠত।’’
স্মৃতি রক্ষা কমিটির সম্পাদক লক্ষ্মীনারায়ণ সিংহ, কমিটির সদস্য তথা শহরের প্রাচীনতম স্কুল জি ডি ল্যাং হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক দেবাশিস সরখেল বলেন, ‘‘কাজটা কিন্তু খুব কঠিন নয়। পার্কের পাশে আবর্জনা ফেলা বন্ধ করে নর্দমায় ঢাকা দিয়ে ফুলগাছ লাগালেই সুশ্রী ফিরবে। সেই সঙ্গে আলোর ব্যবস্থা এবং ছোট ও বড়দের পার্কে বসার ব্যবস্থা করা খুব একটা কঠিন কাজ ছিল না পুরসভার পক্ষে। কিন্তু বামফ্রন্ট বা তৃণমূল কেউই এই বিষয়ে কোনওদিনই উদ্যোগী হয়নি। লক্ষ্মনারায়ণবাবুর আক্ষেপ, ‘‘পুরসভাকে বলেও কাজ করানো যায়নি। কমিটির আর্থিক সঙ্গতি থাকলে আমরাই তা করে দিতাম।’’
তবে স্থানীয় সিপিএম নেতৃত্বের ব্যাখ্যা, পুরবোর্ডে থাকার সময়ে শহরের রাস্তাঘাট, পানীয়জল, নিকাশির মতো ন্যূনতম নাগরিক পরিষেবার উন্নতি করতে গিয়ে তারা পার্কটির সৌন্দর্যায়নে নজর গিতে পারেনি। দলের লোকাল কমিটির সম্পাদক লোকনাথ হালদারের দাবি, ‘‘এই শহরের বাসিন্দাদের ন্যূনতম নাগরিক পরিষেবা গিতে গিয়ে সময় গিয়েছে। ফলে দুঃখজনক ভাবে পার্কটির সৌন্দর্যায়নে আমরা নজর দিতে পারেনি। এ ছাড়া এই কাজে অর্থের ঘাটতিও একটা কারণ।” তবে এ বার নতুন পুরবোর্ডের কাছে পার্কটি সাজাতে তাঁরা ধারাবাহিক ভাবে চাপ দেবেন বলে তিনি জানিয়েছেন। পার্কটির সৌন্দর্যায়নের ক্ষেত্রে সে ভাবে যে নজর দেওয়া হয়নি তা কার্যত স্বীকার করে নিয়েছেন তৃণমূলের প্রাক্তন পুরপ্রধান মদন বরাটও। তবে স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক পূর্ণচন্দ্র বাউরির আশ্বাস, ক্ষুদিরাম পার্কটিকে সাজিয়ে তুলবেন তাঁরা। বিধায়ক বলেন, ‘‘নির্বাচনের সময়েই স্থানীয় মানুষজন আমাকে এই পার্কটির সার্বিক উন্নয়ন করার জন্য বলেছেন। শহরের প্রাণকেন্দ্রে এই পার্কটির সৌন্দর্যায়ন ঘটিয়ে শহরের মুখ হিসাবে তুলে ধরা উচিত ছিল বিগত পুরসভার। নতুন বোর্ডের সঙ্গে আলোচনা করে প্রথমেই এই কাজ করব আমরা।” নতুন পুরপ্রধান ভবেশ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বিধায়ক আমাকে পার্কের বিষয়টি জানিয়েছেন। আমরা শীঘ্রই ক্ষুদিরাম পার্কের প্রয়োজনীয় সংস্কার করে ওই জায়গাটিকে শহরের মুখ হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিচ্ছি।’’