এই পুকুরের পাশেই পড়েছিল শিশুর দেহ। পরিদর্শনে জেলা শিশু সুরক্ষা কমিটির সদস্যেরা। —নিজস্ব চিত্র।
নিহত পড়ুয়ার স্কুল পরিদর্শনে গিয়ে এক গুচ্ছ অসঙ্গতি খুঁজে পেল পুরুলিয়া জেলা শিশু সুরক্ষা কমিটি। ছুটি পেতে প্রথম শ্রেণির এক ছাত্রকে পাথর দিয়ে থেঁতলে খুন করার অভিযোগে সম্প্রতি পুলিশ আটক করেছে ওই আবাসিক স্কুলের অষ্টম শ্রেণির এক পড়ুয়াকে। স্কুল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ করেছেন নিহত ছাত্রের বাবা। তার ভিত্তিতে ছাত্র খুনের ঘটনায় স্কুলের ভূমিকা খতিয়ে দেখছে পুলিশ। পাশাপাশি ঘটনার পৃথক তদন্ত করছে জেলা শিশু সুরক্ষা কমিটিও।
বুধবার জেলা শিশু সুরক্ষা কমিটির চার সদস্য ওই স্কুলে গিয়ে হস্টেল থেকে যে পুকুরপারে ছাত্রের দেহ উদ্ধার হয়, তা ঘুরে দেখেন। ছাত্রাবাসে পড়ুয়ারা কোথায় থাকে, রাতে তারা কাদের দায়িত্বে থাকে, শৌচাগারের অবস্থা কেমন, কী ধরনের বিধি মেনে তারা ক্যাম্পাসের বাইরে যায়, টিফিনের সময় বাইরে থেকে কেউ ঢুকতে পারে কি না— এই সমস্ত বিষয়ে খোঁজ নেন।
স্কুল সূত্রে জানা গিয়েছে, ১৯৯৫ সাল থেকে পঠনপাঠন চলছে। দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাঁচশোর বেশি পড়ুয়া রয়েছে। ছাত্রাবাসে থাকে ১৭৪ জন পড়ুয়া। তাদের মধ্যে ১৩৩ জন ছাত্র, ৪১ জন ছাত্রী। ঘটনার পরে স্কুলে ছুটি পড়ে যাওয়ায় পড়ুয়াদের সঙ্গে এ দিন কমিটির কথা হয়নি।
স্কুল ও ছাত্রাবাস চালানোর জন্য স্কুল শিক্ষা দফতরের কোনও অনুমোদন রয়েছে কি না তা জানতে চান কমিটির সদস্যেরা। কমিটির চেয়ারপার্সন নীলিমা দাস চৌধুরী বলেন, ‘‘অনুমোদন সম্পর্কিত কোনও নথি প্রধান শিক্ষক আমাদের দেখাতে পারেননি।’’ যদিও প্রধান শিক্ষক যুধিষ্ঠির মাহাতোর দাবি, ‘‘সোসাইটি অ্যাক্টে স্কুলের রেজিস্ট্রেশন রয়েছে। ২০২২ পর্যন্ত পুনর্নবীকরণও করা রয়েছে।’’
কমিটির সদস্যেরা জানান, ছাত্রাবাসের কোনও জানালায় রড নেই। শিকবিহীন জানলায় পড়ুয়াদের নিরাপত্তা কতটা থাকে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। টিফিনের সময় স্কুলের প্রধান দরজা খুলে দেওয়া হয়। তখন বাইরে থেকে বাড়ির লোকজন এসে পড়ুয়াদের খাবার দেন। চেয়ারপার্সন নীলিমার প্রশ্ন, ‘‘দেখলাম টিফিনের সময়ে স্কুলের ক্যাম্পাসে ঢোকার জন্য কোনও পরিচয়পত্রের বালাই নেই। যে কেউ তো ঢুকে পড়তে পারে!’’
কমিটির এক সদস্য অশোক মাহাতো বলেন, ‘‘স্কুল চত্বর থেকে প্রায় ৪৫০ মিটার দূরে ওই পুকুর। অভিযোগ যদি সত্যি হয়, তাহলে অষ্টম শ্রেণির ওই পড়ুয়া পূর্ব পরিকল্পনা করেই প্রথম শ্রেণির ছাত্রটিকে স্কুলের বাইরে নিয়ে গিয়ে শিঙাড়া খাইয়ে পুকুরপারে নিয়ে গিয়ে পাথর দিয়ে থেঁতলে মেরেছে। দু’জন ছাত্র স্কুলের বাইরে গেল আর ফিরে এল এক জন ছাত্র। অন্য ছাত্র কোথায় গেল? এটা স্কুল কর্তৃপক্ষের নজরে পড়বে না?’’ তাঁর আরও প্রশ্ন, ছুটির পরে পড়ুয়াদের ক্যাম্পাসের বাইরে ওই পুকুরের অদূরে মাঠে খেলার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়, অথচ সে জন্য কোনও হাজিরা খাতা রাখা হবে না? ক’জন বাইরে গেল আর ক’জন ঢুকল— বোঝার উপায়ই নেই! অষ্টম শ্রেণির ওই ছাত্র টিফিনের পরের পিরিয়ডে গরহাজির থাকলেও পরের ক্লাসে ঢুকেছিল। একটি পিরিয়ডে সে কোথায় ছিল, তা জানতে চাওয়া হবে না?
কমিটির চেয়ারপার্সন বলেন, ‘‘আবাসিক স্কুলের ন্যূনতম যে সব পরিকাঠামো থাকা দরকার তা নেই। নিরাপত্তাজনিত নানা অসঙ্গতি আমাদের চোখে পড়েছে। পরে বৈঠক করে আমরা কী করণীয় তা নিয়ে সিদ্ধান্ত নেব।’’
প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘‘অর্থাভাবেই সঠিক পরিকাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। অষ্টম শ্রেণির ওই ছাত্র জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে স্কুলে ভর্তি হয়। সে যে এমন কাণ্ড ঘটাবে আমাদের ভাবনায় ছিল না। অতীতে এমন ঘটেনি।’’ তাঁর দাবি, পানীয় জল-সহ পরিকাঠামো গড়তে চেয়ে তাঁরা কয়েকবার প্রশাসনেরও দ্বারস্থ হয়েছিলেন। সাড়া পাননি।