Patrasayer

সেবা মন্ত্রেই জীবন কাটান ‘বাসন্তীদি’

মানুষের পাশে দাঁড়ানোটা তাঁর নেশা হয়ে উঠেছে। ছোটবেলায় কাছ থেকে দেখেছেন নিজের বাবা সুধীরচন্দ্র পালকে। বাড়িতে কোনও ভিক্ষাজীবী এলে সুধীরবাবু তাঁকে বলতেন, ‘‘ভিক্ষা করা হলে খেয়ে যেও।’’

Advertisement

তারাশঙ্কর গুপ্ত

পাত্রসায়র শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২০ ০১:২৩
Share:

চলছে পড়াশোনা। নিজস্ব চিত্র

কেউ স্কুলে যাওয়া বন্ধ করেছে শুনলেই তিনি তাকে বোঝাতে ছোটেন। টাকার অভাবে কারও কলেজে ভর্তি আটকে? সেখানেও তিনি সাহায্যের হাত বাড়াচ্ছেন। এলাকার স্বাস্থ্য সচেতনতার কাজেও পঞ্চায়েতের ভরসা সেই ‘বাসন্তীদি’। বাঁকুড়ার পাত্রসায়রের বালসী হাইস্কুলের পার্শ্বশিক্ষিকা বাসন্তী পাল এ ভাবেই এলাকার দুঃস্থদের ‘কাছের মানুষ’ হয়ে উঠেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘আমি ভাগ্যবান যে ভগবান আমাকে এই কাজ করার সুযোগ দিয়েছেন।’’

Advertisement

মানুষের পাশে দাঁড়ানোটা তাঁর নেশা হয়ে উঠেছে। ছোটবেলায় কাছ থেকে দেখেছেন নিজের বাবা সুধীরচন্দ্র পালকে। বাড়িতে কোনও ভিক্ষাজীবী এলে সুধীরবাবু তাঁকে বলতেন, ‘‘ভিক্ষা করা হলে খেয়ে যেও।’’ বাসন্তীদেবীর কথায়, প্রায় দিনই নিজেদের খাবার ভিক্ষাজীবীদের সঙ্গে তাঁরা ভাগ করে খেতেন।

বছর বাহান্নর বাসন্তীদেবী বালসীর আড্ডারপাড়ায় টিনের চালার মাটির বাড়িতে একাই থাকেন। বাবা-মা কয়েকবছর আগে মারা গিয়েছেন। তিন দাদা কর্মসূত্রে বাইরে। বাসন্তীদেবীর কথায়, ‘‘কে বলে একা? গ্রামের মানুষই আমার পরিবার।’’ তিনি জানান, সোনামুখী কলেজ থেকে ১৯৮৭ সালে স্নাতক হওয়া পর থেকে গ্রামবাসীর পাশে দাঁড়ানো শুরু করেন। টিউশন পড়ানোর রোজগার থেকেই অল্প অল্প করে লোকজনকে সাহায্য করতে শুরু করেন।

Advertisement

বাসিন্দারা জানান, কয়েক বছর আগে স্থানীয় রাজার দীঘিরপাড় এলাকায় বসবাস শুরু করে এক যাযাবর গোষ্ঠী। তাঁদের বাচ্চারা স্কুলে যেত না। বাসন্তীদেবীই অভিভাবকদের বুঝিয়ে শিশুদের স্কুলে পাঠান। রোজ সকালে ওই পাড়ায় গিয়ে বিনা পয়সায় পড়ান। এক দিন ওই এলাকার বসন্ত রোগে অসুস্থ শিশুদের প্রকাশ্যে ঘোরাঘুরি করতে দেখে নিজেই পাত্রসায়র ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যান। স্বাস্থ্য কর্মীদের নিয়ে ওই এলাকায় গিয়ে সচেতনতার প্রচার চালান।

বালসী হাইস্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী নন্দিনী কর্মকার আর্থিক সমস্যার জন্য পড়া ছেড়ে দিয়েছিল। তার মা রুমি কর্মকার বলেন, ‘‘মেয়েদের কেন পড়া জরুরি, তা বাসন্তীদি এসে বুঝিয়েছিলেন। পরে নিজে স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে, ব্লক প্রশাসনের কাছে সাহায্যের ব্যবস্থা করায় মেয়েটা ফের পড়া শুরু করেছে।’’ গ্রামের ছেলে সংগ্রাম ভট্টাচার্য জানান, টাকার অভাবে নলহাটি গর্ভনমেন্ট পলিটেকনিক কলেজে ভর্তি হতে পারছিলেন না। বাসন্তীদেবীই সব ব্যবস্থা করেছিলেন। এখনও মাঝে মধ্যে খরচপাতি দেন। আশুতোষ কবিরাজ স্নাতক উত্তীর্ণ হয়ে চাকরির পরীক্ষা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু বইপত্র কেনার সামর্থ নেই জেনে পাশে দাঁড়ান বাসন্তীদেবী। পাত্রসায়র কলেজে ভর্তির সময় থেকে উচ্চশিক্ষায় পর্না দাসকে সাহায্য করে যাচ্ছেন তিনি। কমলেশ কেওড়া নামে এক দিনমজুর অভিভাবকের কথায়, ‘‘দিদি আছেন বলেই আমাদের ছেলেগুলোর পড়াশোনা হচ্ছে। উনি খাতা-পেন কিনে দেন। নিজের সামান্য রোজগার। তা-ও বিলিয়ে দেন।’’

বালসী ২ পঞ্চায়েতের প্রধান সঞ্জিত মাঝি বলেন, ‘‘শুধু গরিব ছাত্রছাত্রীদের বিনা পয়সায় পড়ানোই নয়। অসুস্থদের সেবা করা, সচেতনতার প্রচার থেকে গরিব মানুষের মেয়ের বিয়ে— সব কিছুতেই উনি পাশে দাঁড়ান।’’ আর বাসন্তীদেবী বলেন, ‘‘এতে আমারও স্বার্থ আছে। শ্রীরামকৃষ্ণ সারদাদেবী ও বিবেকানন্দের আদর্শে আমি দীক্ষিত। ওই মানুষগুলোর পাশে থাকলে আমার আত্মিক উন্নয়ন হয়।’’ তাঁর ইচ্ছা, সবাই যদি গরিবদের জন্য নিজের কিছুটা দেন, তাহলে সমাজে আর কষ্ট থাকে না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement