এই মাঠেই হয় পৌষমেলা। নিজস্ব চিত্র
পৌষমেলা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে বিশ্বভারতীর কর্মসমিতির বৈঠকে। শুক্রবারের সেই সিদ্ধান্তের প্রভাব শান্তিনিকেতনের অর্থনীতির উপরে পড়বে বলে জানাচ্ছেন মেলার সঙ্গে যুক্ত নানা পক্ষ। পৌষমেলাকে কেন্দ্র করে গোটা ডিসেম্বর মাসজুড়ে বোলপুর শহরে প্রায় ১০০ কোটি টাকার উপর আর্থিক লেনদেন হয়। তাই, কোনও আলাপ-আলোচনা ছাড়াই কর্মসমিতির এমন সিদ্ধান্তের প্রবল বিরোধিতা করেছেন অনেকেই।
১৮৯৪ সালে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের হাত ধরে শান্তিনিকেতনে সূচনা হয় পৌষ উৎসবের। একদিকে উপাসনা এবং অন্যদিকে মেলা, এই দুয়ে মিলে পৌষ উৎসব আয়োজনের পরিকল্পনা করেন মহর্ষি। এই উদ্দেশ্যেই তিনি গড়ে তোলেন শান্তিনিকেতন ট্রাস্ট। ১৯২১ সাল পর্যন্ত পৌষ উৎসবের যাবতীয় দায়িত্ব ছিল ট্রাস্টেরই হাতে। ১৯২১ সালে বিশ্বভারতীর আত্মপ্রকাশের পর ট্রাস্টের অন্যতম সদস্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পৌষ উৎসব আয়োজনে বিশ্বভারতীর কর্মী, অধ্যাপক ও ছাত্রদের প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত করেন। তখন থেকেই নিরবচ্ছিন্নভাবে শান্তিনিকেতন ট্রাস্টের পরিচালনায় এবং বিশ্বভারতীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় আয়োজিত হয়ে চলেছে পৌষ উৎসব। সেই অর্থে বিশ্বভারতীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতার শতবর্ষের প্রাক্কালেই পৌষমেলা বন্ধের ঘোষণা করল কর্তৃপক্ষ।
মেলার মূল পরিচালন সমিতি, শান্তিনিকেতন ট্রাস্টের সম্পাদক অনিল কোনার বলেন, “প্রতি বছর অক্টোবর মাসের শেষের দিকে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ, শান্তিনিকেতন ট্রাস্ট এবং বীরভূম জেলা প্রশাসনের বৈঠকের মধ্য দিয়ে মেলা সংক্রান্ত যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এ বছর হঠাৎ করে কোনও পক্ষের সঙ্গে কোনও আলোচনা না করে বিশ্বভারতী এমন সিদ্ধান্ত নিল।’’
তবে গত বছর থেকেই শান্তিনিকেতন ট্রাস্ট পৌষমেলা আয়োজনে তাঁদের অক্ষমতার কথা স্পষ্টভাবে জানিয়েছে বলে জানান রাষ্ট্রপতি মনোনীত বিশ্বভারতীর কর্মসমিতির সদস্য সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘পৌষমেলায় খরচের উত্তরোত্তর বৃদ্ধি এবং বিশৃঙ্খলাকে মাথায় রেখে ট্রাস্টের তরফে বিশ্বভারতীকে পৌষমেলা আয়োজনের সমস্ত দায়িত্ব গ্রহণ করতে অনুরোধ করা হয়।’’ বিশ্বভারতীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছাড়া যে কেবল শান্তিনিকেতন ট্রাস্টের পক্ষে বিপুল পৌষমেলা আয়োজন সম্ভব নয় তা মানছেন অনিলবাবুও।
আয়োজক যাঁরাই হোন না কেন, পৌষমেলা বন্ধের সিদ্ধান্তের বিরোধিতার সুর শোনা গিয়েছে অনেকের মুখেই। পাঠভবনের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সুপ্রিয় ঠাকুর বলেন, “বর্তমান পরিস্থিতিতে জমায়েত এড়িয়ে চলার সিদ্ধান্ত সঠিক হলেও পৌষমেলা বরাবরের মতো বন্ধ করে দেওয়া অসম্ভব। এই সিদ্ধান্ত বিশ্বভারতীর ঐতিহ্যকেই বিনষ্ট করবে। এক বিরাট সংখ্যার মানুষ আর্থিকভাবেও পৌষমেলার উপর নির্ভরশীল, তাদের কথাও বিশ্বভারতীকে ভাবতে হবে।”
কর্মিসভার সভাপতি গগন সরকার মনে করছেন এই সিদ্ধান্ত কবিগুরুর দর্শনের পরিপন্থী। তিনি বলেন, “রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন বিশ্বভারতীকে কেন্দ্র করে আশেপাশের গ্রাম ও শহরগুলির অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াক। বর্তমান উপাচার্য সেই স্বপ্নের ভিত্তিটাকেই ধ্বংস করে দিচ্ছেন।”
বিশ্বভারতীর এই সিদ্ধান্তের ফলে বোলপুরের ব্যবসায়ীরা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বলে মনে করছেন সকলেই। কবিগুরু হস্তশিল্প উন্নয়ন সমিতির সম্পাদক আমিনুল হুদা বলেন, “এই সিদ্ধান্তের ফলে প্রায় কয়েক কোটি টাকার আর্থিক লোকসান হবে। তবে ২০১৯ সালের পৌষমেলায় যে ব্যবহার ব্যবসায়ীরা কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে পেয়েছেন, তাতে সেই ভাবে মেলা হওয়ার থেকে না হওয়াই ভাল।’’
কেবল আর্থিক ক্ষতিই নয়, মেলা বন্ধের সিদ্ধান্ত তাঁদের আবেগ-অনুভূতিকেও আঘাত করছে বলে জানাচ্ছেন প্রাক্তনীরা। বিশ্বভারতীতে প্রায় ১৬ বছর ছাত্রী জীবন কাটিয়ে আসা তনুশ্রী মল্লিক বলেন, “মেলা বন্ধের অনেক কারণ থাকতে পারে। সেই তর্কে না গিয়ে শুধু এটুকু বলতে পারি দুর্গাপুজোর পর যদি কোনও অনুষ্ঠানের জন্য সারা বছর অপেক্ষা করে থাকি, তবে তা পৌষমেলা। এটি শুধু মেলা নয় আমাদের পুনর্মিলন উৎসবও। মেলা বন্ধ হয়ে যাবার সিদ্ধান্ত কোনও ভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।”
তবে এই বিতর্ক নিয়ে কিছু বলতে চায় না বিশ্বভারতী। বিশ্বভারতীর ভারপ্রাপ্ত জনসংযোগ আধিকারিক অনির্বাণ সরকার বলেন, “বিশ্বভারতী সংক্রান্ত যে কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণের সর্বোচ্চ কমিটি হল কর্মসমিতি। তারা তাদের সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। এর বাইরে আমাদের আর কোনও বক্তব্য নেই।”