কাশীপুরের পাহাড়পুরে। নিজস্ব চিত্র।
পর্যটনে বাড়তি অক্সিজেন জোগানোর সঙ্গে, হারিয়ে যাওয়া পাখপাখালিদের আশ্রয় দিতে বট-পাকুড়দের ফেরাবে ‘মাটির সৃষ্টি’। বড়দিনের আগে, শুক্রবার ওই প্রকল্পের অধীনে পুরুলিয়ায় চারটি পর্যটনস্থলের দরজা খোলার পরে, তেমনই আশা জেলা প্রশাসনের। পর্যটনস্থলগুলির সূচনা করে, জেলাশাসক রাহুল মজুমদার এ দিন বলেন, “প্রকৃতি ছিল ‘মাটির সৃষ্টি’তে, কিন্তু পর্যটন ছিল না। আর পর্যটনে ‘মাটির সৃষ্টি’ ছিল না। জেলা প্রশাসন এ দু’য়ের মেলবন্ধনে প্রকল্পের অধীনে চারটি প্রকল্পস্থলের দরজা মানুষজনের জন্য খুলে দিয়েছে।”
কাশীপুরের পাহাড়পুর, পুঞ্চার বদড়া, মানবাজার ১ ব্লকের হাতিপাথর ও বরাবাজারের রাজাপাড়ায় চারটি পর্যটনস্থলের উদ্বোধন হয়েছে এ দিন। প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, মনোরম জলাশয়ের পাড়ে, সবুজ টিলার ক্যানভাসে ‘চা-অবকাশ’-এর আড্ডায় চায়ে চুমুক দিতে দিতে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার ব্যবস্থা থাকছে কাশীপুরের পাহাড়পুরে।
জেলাশাসক বলেন, “ইচ্ছে করলে, বেড়াতে এসে লেকে নৌকাবিহার, জলাশয়ে মাছ ধরা বা আদিবাসী সংস্কৃতির নানা অনুষ্ঠান দেখার সুযোগও পাবেন পর্যটকেরা।” স্থানীয় পঞ্চায়েতের প্রধান সুমিত্রা মুর্মু জানান, চা-অবকাশে শালপাতায় গরম কচুরি-তরকারির সঙ্গে স্থানীয় খাবারও মিলবে। আপাতত ‘ডে টুরিজম’ কেন্দ্র হিসাবে চালু হলেও ভবিষ্যতে যাতে রাত্রিবাসের ব্যবস্থা করা যায়, তা-ও দেখা হবে বলে জানান জেলা পরিষদের জনস্বাস্থ্য কর্মাধ্যক্ষ সৌমেন বেলথরিয়া।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পুঁজি নিয়ে হাজির পুঞ্চার বদড়াও। সবুজ পার্কে উড়ে বেড়াচ্ছে রঙ-বেরঙের প্রজাপতি। যে দিকে চোখ যায়, সবুজ—জঙ্গল নিম, বট, পাকুড়, আমলকি, আম, জাম, কাঁঠালের সঙ্গে রয়েছে হরেক নাম না জানা গাছও। ‘টাওয়ার’-এ বসে ‘লেমনগ্রাস চা’-এ চুমুক দেওয়ার ব্যবস্থা থাকছে। রয়েছে ঘোড়ায় টানা এক্কা গাড়িও। পুঞ্চা ব্লকের লাখরা পঞ্চায়েতের বদড়ায় ‘মাটির সৃষ্টি’ প্রকল্পে তৈরি হওয়া জীববৈচিত্র পার্কটি শুধু বেড়ানোর জায়গা হিসেবে গড়ে তোলা নয়, হারিয়ে যাওয়া নানা পাখিদের আশ্রয় দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে বলে আশাবাদী জেলা পরিষদের সভাপতি সুজয় বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, “সুসংহত চাষাবাদ ও প্রাণিপালনের মাধ্যমে উপভোক্তাদের বিকল্প রুজির সন্ধান দেওয়াই ‘মাটির সৃষ্টি’র লক্ষ্য। পাশাপাশি, প্রশাসন ও উপভোক্তাদের যৌথ প্রয়াসে প্রকৃতির সৌন্দর্যকে পুঁজি করে পর্যটন বিস্তারের ভাবনাও নেওয়া হয়েছে। পর্যটনস্থলগুলি তারই ফসল।”
পাশাপাশি, মানবাজার ১ ব্লকে, কংসাবতী নদীর পাশে, বড় বড় পাথর ঘেরা হাতিপাথরেও সবুজের ছোঁয়া লেগেছে ‘মাটির সৃষ্টি’র হাত ধরে। ইতিমধ্যে সেখানে ভিড় জমাতে শুরু করেছে পরিযায়ী পাখিদের দল। রয়েছে রাত্রিবাসের ব্যবস্থা। এ ছাড়া, চড়ুইভাতির নতুন ঠিকানা হিসাবে বরাবাজারের রাজাপাড়াতেও স্থানীয় জলাশয়কে ঘিরে গড়ে তোলা হয়েছে উদ্যান। থাকছে নৌকাবিহারের ব্যবস্থা, জানাচ্ছে প্রশাসন।
পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদ মন্ত্রী সন্ধ্যারানি টুডু বলেন, “মাটির সৃষ্টি মানুষকে বিকল্প রুজির দিশা দেখানোর লক্ষ্যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি আদর্শ প্রকল্প। চাষাবাদ তো বটেই, পর্যটনের মাধ্যমেও প্রকল্পের উপভোক্তারা রুজির দিশা পাবেন।”
পর্যটনস্থলগুলি চালুর সঙ্গে সুদিনের আশায় বুক বাঁধছেন প্রকল্পের উপভোক্তারাও। পাহাড়পুরের সুরজমণি হাঁসদা, মাকু সরেন, তুলসী সরেনরা লকডাউনের আগেও আসানসোলে যেতেন দিনমজুরের কাজে। তাঁরাই এখন চা-অবকাশের নানা কাজ সামলাচ্ছেন। তাঁদের কথায়, “গ্রাম থেকে সাত কিলোমিটার হেঁটে ইন্দ্রবিল স্টেশনে গিয়ে ট্রেন ধরে আসানসোলে যেতাম। সে কাজ ছেড়েছি। পাহাড়পুরে ‘হাসাগড়ন তিরলৌ সেমলেট মহিলা সমিতি’-র হয়ে (‘মাটির সৃষ্টি’ প্রকল্পে) গ্রামেই কাজ করছি। দিন-রাত খেটে আমরা প্রকল্পকে দাঁড় করিয়েছি।” জেলাশাসক বলেন, “উপভোক্তাদের প্রকল্পের সঙ্গে একাত্ম হওয়া ভাল ব্যাপার।’’