ঝাড়খণ্ডে বিজেপির হারের প্রভাব দেখা গেল লাগোয়া বীরভূমেও। পড়শি রাজ্যে বিজেপির হারে স্বভাবতই খুশি তৃণমূল নেতৃত্ব। স্থানীয় বিজেপির নেতাকর্মীরা একান্তে কিছুটা হতাশার কথা জানালেও মুখে তা মানতে নারাজ।
রাজ্যের অন্যান্য জেলার মধ্যে সব থেকে বেশি ঝাড়খণ্ড সীমান্ত ঘেঁষা এলাকা রয়েছে বীরভূমেই। রাজনগর থেকে মহম্মদবাজার, রামপুরহাট, নলহাটি, মুরারই এই সমস্ত এলাকা গুলি থেকে এক থেকে তিন কিলোমিটারের মধ্যেই ঝাড়খণ্ড। আবার রামপুরহাট, নলহাটি, মুরারই এলাকার মধ্যে কিছু কিছু এলাকার পঞ্চাশ মিটার দূরত্বের মধ্যেই ঝাড়খণ্ড। তার মধ্যে মুরারই থানার দুলান্দি যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে নলহাটি থানার ভবানন্দপুর, রামপুরহাট থানার তুম্বনি, আড়ান্দা, নারায়ণপুরের মতো এলাকা। তাই ঝাড়খণ্ডের মানুষজনের যেমন বীরভূমের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে নিয়মিত। বীরভূমের মানুষজনও তাঁদের বাজার হাট ঝাড়খণ্ডের এলাকায় গিয়ে করে আসেন। পাথর শিল্পাঞ্চলে ব্যবসার ক্ষেত্রেও ঝাড়খণ্ডের দুমকা, শিকারিপাড়া, পাকুড়, মহেশপুর এই সমস্ত এলাকার সঙ্গে বীরভূমের রামপুরহাট, নলহাটি, মুরারই এলাকার দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। ঝাড়খণ্ডের শিকারিপাড়া থানার চিত্রাগড়িয়া, সারাসডাঙা, পিনারগড়িয়া এই সমস্ত পাথর খাদান এলাকা থেকে পাথরের জোগানেই রামপুরহাট এলাকায় বড়পাহাড়ি, বারমেসিয়া, তেঁতুলবান্দি এলাকার পাথর শিল্পাঞ্চল চালু থাকে।
বীরভূমের এত কাছে থাকা ঝাড়খণ্ডে বিজেপি সরকারের পতনে স্বভাবতই খুশি বীরভূমের তৃণমূল নেতৃত্ব। জেলার রামপুরহাট বিধানসভার মধ্যে ঝাড়খণ্ড লাগোয়া সব থেকে বেশি অঞ্চল পড়ছে। রামপুরহাট বিধানসভার নারায়নপুর, কুশুম্বা, বনহাট, মাসড়া, কাপিষ্টা, হিংলো, রামপুর, ভাড়কাটা এই সমস্ত অঞ্চলগুলি লাগোয়া ঝাড়খণ্ড রাজ্য পড়ছে। গত লোকসভা নির্বাচনে এই অঞ্চলগুলির মধ্যে অধিকাংশ অঞ্চলেই তৃণমূলের ফল খারাপ হয়। সেখানে ঝাড়খণ্ডে এই ফলে খানিকটা আত্মবিশ্বাসী স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব। রামপুরহাটের বিধায়ক, মন্ত্রী আশিস বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বিজেপি সরকারের যেখানে পতন ঘটবে সেখানেই আমরা খুশি হব। কারণ এই সরকারের উৎখাত আমরা চাই। বিজেপি সরকারের আগ্রাসী নীতি সাধারণ মানুষ যে আর পছন্দ করছেন না তা আবারও প্রমাণ হল।’’
ঝাড়খণ্ড ঘেঁষা বীরভূমের তুম্বনি গ্রামের বাসিন্দা তথা রামপুরহাট ১ পঞ্চায়েত সমিতির সহ সভাপতি পান্থ দাস বলেন, ‘‘ঝাড়খণ্ডে বিজেপি সরকারের পতন ঘটার কারণ ওই এলাকার আদিবাসী মানুষজনের ক্ষোভ। আমাদের এলাকার আদিবাসী মানুষজন ২ টাকা কেজি দরে চাল পান, কন্যাশ্রী প্রকল্পের সুবিধা পান, সবুজসাথী প্রকল্পে ছাত্র ছাত্রীরা সাইকেল পান কিন্তু ঝাড়খণ্ডের মানুষজন এই সমস্ত সুবিধা পান না। তাই বিজেপির অপশাসনের বিরুদ্ধে তাঁরা ভোটে জবাব দিয়েছেন।’’ ঝাড়খণ্ড সীমানা ঘেঁষা মাসড়া অঞ্চলের বাসিন্দা মৈনুদ্দিন হোসেন বলছেন, ‘‘রামপুরহাট থানা লাগোয়া ঝাড়খণ্ডের এলাকাগুলিই শিবু সোরেনের আন্দোলন ক্ষেত্র। এই সমস্ত এলাকা থেকে বরাবরই ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা আদিবাসী জনজাতির সমর্থন পেয়ে এসেছে।’’
কাজ না পাওয়ার প্রভাবও ভোটে পড়েছে বলে মনে করছেন অনেকে। ঝাড়খণ্ড লাগোয়া নলহাটির হরিদাসপুরের সিপিএম নেতা সনৎ প্রামাণিকের ব্যাখ্যা, ‘‘ওই এলাকার মানুষজন বিজেপি সরকারকে দেখেছেন। একশো দিনের কাজ বন্ধ, পাথর শিল্পাঞ্চল বন্ধ। রোজগারের জন্য এলাকার মানুষজনকে বাইরে খাটতে যেতে হয়। এ সবের প্রভাবই পড়েছে ভোটে।’’ কার্তিকডাঙা গ্রামের বাসিন্দা, লক্ষ্মীনারায়ণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আশিস মাল জানালেন, ‘‘দেড় বছর যাবত এলাকার সুন্দরপাহাড়ি, রদিপুর, পাখুড়িয়া, মহেশপুর এলাকার পাথর খাদান থেকে পাথর শিল্পাঞ্চলগুলি বন্ধ। এর ফলে এলাকার রুজি রোজগার বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বন জঙ্গল থেকেও আদিবাসী মানুষজনের বিকল্প আয়ের পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তাই ওখানকার মানুষজন বিজেপি সরকারের পতন চাইছিলেন।’’
ঝাড়খণ্ড সীমানা লাগোয়া এলাকার বীরভূমের বিজেপির নেতা-কর্মীরাও অনেকে একান্তে মানছেন ঝাড়খণ্ডের ফলের প্রভাব কিছুটা এ রাজ্যেও পড়বে। জেলা বিজেপির সহ সভাপতি শুভাশিস চৌধুরী অবশ্য বলেন, ‘‘ঝাড়খণ্ড যাই হোক না কেন এ রাজ্যে তার কোনও প্রভাব পড়বে না।’’