প্রস্তুতি। নানুরের বঙ্গছত্র গ্রামে কালীপুজোর প্যান্ডেলের কাজ চলছে। —নিজস্ব চিত্র।
ওঁদের কেউ হিন্দু, কেউ বা মুসলিম। কেউ অবস্থাপন্ন পরিবারের বধূ। কেউ পরের বাড়িতে কাজ করেন। যাবতীয় ‘ছুঁৎমার্গের’ বেড়া ভেঙে দিয়েছে নানুরের বঙ্গছত্র গ্রামের চন্দ্রমুখীর কালীপুজো। দীর্ঘদিন ধরেই ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এলাকার সকলে ওই পুজোয় মেতে ওঠেন।
প্রচলিত রয়েছে, তিন শতাধিক বছর আগে বছর আগে চন্দ্রমুখী মুখোপাধ্যায় নামে এক স্বামীহারা তরুণী স্থানীয় উলোসোনা নামে একটি পুকুর পাড়ের শ্মশানে তন্ত্র সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেন। তিনিই গ্রামের পূর্বপাড়ায় তন্ত্রমতে ওই কালীপুজোর প্রচলন করেন। সেই পুজোটিই এলাকায় চন্দ্রমুখীর পুজো হিসাবে পরিচিত। বছর পঞ্চান্ন আগে চন্দ্রমুখীর পরিবারের লোকেরা ওই পুজো পরিচালনার ভার গ্রামবাসীদের হাতে তুলে দেন। সেই থেকে সর্বজনীন হয়ে উঠেছে ওই পুজো। গ্রামবাসীদের উদ্যোগে গড়ে উঠেছে সুদৃশ্য মন্দির। আজও গ্রামে অন্য কোনও কালীপুজো হয় না।
সর্বজনীনতার ছোঁয়া লাগলেও ওই পুজো ঘিরে রয়েছে আজও চন্দ্রমুখীর প্রচলিত প্রথা। সেই প্রথা মেনেই আজও ওই পুজোয় মন্দির, পঞ্চমুণ্ডির আসন এবং মহাশ্মশানে ভোগ নিবেদন করা হয়। ভোগে ফল, মিষ্টি, অন্নের পাশাপাশি দেওয়া হয় মাছ-মাংস এবং মদও। রীতি মেনে আজও পুজো শেষে মন্দির এবং পঞ্চমুণ্ডির আসনে ভোগ দেওয়ার পরে পুরোহিতকে পুকুরে স্নান করে বিবস্ত্র হয়ে মহাশ্মশানে ভোগ নিবেদন করে আসতে হয়। পুরোহিত সাধন ঠাকুর বলেন, ‘‘পুরুষানুক্রমেই রীতি মেনে আমাদের ওই কাজটি করতে হয়।’’
এক দিনের ওই পুজো ঘিরে বঙ্গছত্র গ্রামে উৎসবের মেজাজ। হবে পাঁচ দিন ব্যাপী যাত্রা, কবিগান সহ নানা অনুষ্ঠান। পুজোয় শামিল হন আশপাশের বহু গ্রামের মানুষজন। পুজোয় নৈবেদ্য পাঠান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ। স্থানীয় কুলিয়া গ্রামের পূর্ণিমা বিবি, তানিয়া সুলতানাদের কথায়, ‘‘আমরা বিভিন্ন বিষয়ে মা কালীর কাছে মানত করি। সেই উপলক্ষে নৈবেদ্য পাঠাই।’’
জয়নাল শেখ, ঈশা খাঁ বলেন, ‘‘মানত থাক বা নাই থাক, আমরা ওই কালীপুজোয় শামিল হই। পুজো পরিচালনার জন্য সাধ্যমতো চাঁদা দিই।’’
গ্রামের বধূ পায়েল অধিকারী, পিঙ্কি ঘোষ বলেন, ‘‘আমাদের গ্রামে দুর্গাপুজো আছে। কিন্তু, কালীপুজোর জাঁকজমকই বেশি। তাই দুর্গাপুজোর পরিবর্তে কালীপুজোতেই বিবাহিত মেয়ে এবং আত্মীয়স্বজন আসেন।’’
সব থেকে খুশি কচিকাঁচারা। দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র প্রতীক ঘোষ, সমাপ্তি অধিকারী বলেন, ‘দুর্গাপুজো শেষ হয়ে যাওয়ার মন খারাপ ভুলিয়ে দেয় কালীপুজো। টানা পাঁচ দিন খুব আনন্দে কাটে।’’ পুজো কমিটির সম্পাদক বিকাশ রায় এবং অন্যতম সদস্য ছোট্টু পাল জানান, দীর্ঘদিন ধরেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সাক্ষ্য বহন করে চলেছে এই পুজো।