ঘরে ফেরার আনন্দে নিগম, পিছনে চাইল্ড লাইনের কর্মীরা। — নিজস্ব চিত্র
বিষয়টা তাঁদের কাছে সত্যিই চ্যালেঞ্জের ছিল। আর তা বাস্তবে করতে পেরে ঢের বেশি চ্যালেঞ্জ নিতে তৈরি তাঁরা।
কেন না রামপুরহাট থেকে সুদূর মহারাষ্টে প্রায় ১৭০০ কিলোমিটার দূরের মানা থানার পোটা নামের প্রত্যন্ত গ্রামের সতের বছরের এক কিশোরকে তাঁরা ফেরত পাঠাতে সক্ষম হয়েছেন। ওই কিশোরের নিগম। জন্ম থেকেই সে সেরিব্রাল পলসি আক্রান্ত। প্রায় আট মাস আগে নিখোঁজ হয়ে যায়। রামপুরহাট স্টেশনে রেল পুলিশ তাঁকে গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর উদ্ধার করে। কেবলমাত্র মারাঠি ভাষা জানা এমন একজন অসুস্থ কিশোরকে রেলপুলিশ উদ্ধার করার পর জেলা চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির সঙ্গে যোগাযোগ করে। সেখান থেকে ২২ সেপ্টেম্বর রামপুরহাট স্প্যাসটিকস অ্যান্ড হ্যান্ডিক্যাপড সোসাইটিতে স্বল্পকালীন আবাসিক হোমে নিগমের থাকা খাওয়া এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা হয়। এবং সেখানেই জেলা চাইল্ড লাইনের রামপুরহাট শাখা নিগমের কাউন্সেলিংয়ের দায়িত্ব পায়।
জেলা চাইল্ড লাইনের কাউন্সেলর মাধবরঞ্জন সেনগুপ্ত বলেন, ‘‘একজন সেরিব্রাল পলসি আক্রান্ত কিশোর, যে বাংলা ভাষা জানে না তাকে ঘরে ফেরানো চ্যালেঞ্জ ছিল। সেই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে ওই কিশোরকে ঘরে ফেরাতে ভাল লাগছে।” রামপুরহাট চাইল্ড লাইনের মুখ্য কর্মকর্তা রিয়াজুল ইসলাম বলেন, ‘‘ওর সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পেরেছিলাম মারাঠি ভাষার সঙ্গে হিন্দি ভাষাও বুঝতে পারে। কিন্তু লিখতে পড়তে কিছুই জানে না। তার উপর ছিল মানসিক ও শারীরিক অক্ষমতায় কথা বলার জড়তা। তবুও দিন কয়েকের প্রচেষ্টায় ও কেবল ওর নাম নিগম বলতে পারে।”
রিয়াজুল জানান, নিগম তাঁর জেলার নাম আকোলা এবং কাছাকাছি রেল স্টেশনের নাম মন্ডুরা বলতে পারে। তার পর থেকেই নেট ঘেঁটে মহারাষ্ট রাজ্যের আকোলা চাইল্ড লাইনের ঠিকানা জোগাড় করতে পারি। সেখানে নিগমের ফটো এবং কাউসিলিং-এর রিপোর্ট পাঠানো হয়। তাঁরা সংশ্লিষ্ট থানা ও বাড়ির ঠিকানা জোগাড় করে নিগমের বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এবং নিগম সম্বন্ধে পুরো তথ্য জোগাড় করতে থাকেন। ইতিমধ্যে প্রায় চার মাস পরে হারিয়ে যাওয়া ছেলের সন্ধান পান নিগমের পরিবার। জেলা চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির চেয়ারম্যান নিত্যানন্দ রায় বলেন, ‘‘কিশোরকে বাড়িতে ফেরত পাঠাতে চাইল্ড লাইনের কর্মীরা সব ব্যবস্থা করেছেন। খুবই ভাল লাগছে।’’
মহারাষ্ট্রের আকোলা জেলার চাইল্ড লাইনের কাউন্সিলর প্রশান্ত বাম্বোদকর বলেন, ‘‘মহারাষ্টের একটা প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে হারিয়ে যাওয়া কিশোরকে অত দূরে পাওয়া গিয়েছে শুনে আনন্দ হয়েছিল। তার পর থেকেই আমরাও কিশোরটির পরিবার ও পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার রামপুরহাট চাইল্ড লাইনের সঙ্গে যোগাযোগ করি। নিগম বাড়ি ফিরছে শুনে ভালো লাগছে।’’
তাঁদের কথায়, আট মাস আগে বাড়ির সকলের অবর্তমানে ট্রাক্টর ধরে বাড়ি থেকে দু’কিলোমিটার দূরে মন্ডুরা স্টেশনে প্যাসেঞ্জার ট্রেন ধরে পালিয়ে যায় নিগম। বড় ছেলেকে এতদিন পরে কাছে পাওয়ার জন্য অধীর অপেক্ষায় বসে আছেন গোটা পোটা গ্রাম। নিগমের পরিবার। বাবা অজয় প্রহ্লাদ মোহদ ও মা চিত্রা মোহদ। একমাত্র দাদাকে এতদিন পরে কাছে পাওয়ার জন্য অপেক্ষায় প্রহর গুনছে নিগমের দুই বোন নিকিতা ও নিশা।
অজয়বাবু বলেন, ‘‘বাড়িতে কেউ ছিলাম না। ছেলেটা বাড়ি থেকে ওই ভাবে যে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যেতে পারে ভাবতে পারিনি। দু’ দিন পরেই মানা থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করেছিলাম। মুম্বই, ইলাহাবাদ বিভিন্ন স্টেশনে খোঁজ করেছিলাম। কিন্তু কোথাও হদিশ পাইনি। চার মাস আগে জানতে পারি ও পশ্চিমবঙ্গে আছে।’’
আর নিগম?
বাড়ি ফেরার খবরে খুশি সে। বৃহস্পতিবার বিকালে রামপুরহাট স্টেশনে ট্রেন ধরার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে ভাঙা হিন্দিতে ফিল্মি গানের কলি ধরে সে।