স্বপ্নের উড়ানে বাধা অভাবই

কেউ চোখে দেখে না, পড়তে বসে মাকে খোঁজে পড়ে দেওয়ার জন্য। কেউ এলাকায় সেরার শিরোপা নিয়েও উচ্চ মাধ্যমিকের খরচের কথা ভেবে মাথা নিচু করে বসে।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১২ মে ২০১৬ ০২:৩১
Share:

কেউ চোখে দেখে না, পড়তে বসে মাকে খোঁজে পড়ে দেওয়ার জন্য। কেউ এলাকায় সেরার শিরোপা নিয়েও উচ্চ মাধ্যমিকের খরচের কথা ভেবে মাথা নিচু করে বসে। কেউ আবার মায়ের টিউশনের টাকায় পড়াশুনা চালিয়ে ৬৬৪ পেয়েও ডাক্তারির স্বপ্ন ভুলতে চাইছে! পড়শি থেকে স্কুলের শিক্ষক সবাই যখন ওদের শুভেচ্ছা জানাচ্ছে, বাড়িতে ভিড় করে দাঁড়িয়ে, তখনও ওদের চিন্তা, কে দেবে উচ্চ-শিক্ষার খরচ!

Advertisement

পিউয়ের গল্প

মাত্র তিন বছর বয়েসেই দৃষ্টিশক্তি সম্পূর্ণ ভাবে হারিয়েছিল মেয়েটি। দৃষ্টিপথে জমাট অন্ধকার।

Advertisement

‘‘একটু পড়ে দেবে মা... দিদি, দিদি আছিস?’’

পড়তে বসে পড়ে দেওয়ার জন্য এমনই অনুনয় করত যে মেয়েটি, সেই আজ সব প্রতিকূলতা কাটিয়ে সকলের চোখের মণি! এলাকায় সকলের মুখে তার নাম!

অধ্যবসায় ও জেদ থাকলে কী করা যায় তার প্রমাণ রাখল ইলামবাজারের শীর্ষা শৈলজাকান্ত উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্রী পিউ চক্রবর্তী। সহপাঠীদের যেখানে কোনও সমস্যা নেই সেখানে একশো শতাংশ শারিরীক প্রতিকূলতা সত্বেও এবারে মাধ্যমিকে স্কুলের সেরা পিউ-ই! চোখ না থাকলে পাড়াশোনা চালানো এমনিতেই অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। সঙ্গী নিদারুণ দারিদ্রতা। তবুও জয়ী পিউ!

তার প্রাপ্ত নম্বর ৫২১। শতাং‌শের হিসাবে ধরলে ৭৪.৪। কিন্তু এ পর্যন্ত আসা গেলেও ভাবিষ্যত কী, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পিউ ও তার পরিবার।

দুবরাজপুরের কোটা গ্রামে বাড়ি পিউদের। দুই বোন, বড় পায়েল দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ে। হতদরিদ্র পরিবারটির সম্বল বলতে একটি ইন্দিরা আবাস যোজনায় পাওয়া বাড়ি। মা মমতাদেবীও প্রায় অন্ধ। গাঁ ঘারে দু’একটি পুজো ও কার্যত ভীক্ষাই জীবিকা পিউর বাবা হরপ্রসাদবাবুর। আর সময় পেলেই মেয়ের জন্য বরাদ্দ। স্কুলে দিয়ে আসা এবং নিয়ে আসা সবই হরপ্রসাদবাবুর দায়িত্ব। অন্য কাজ আর তিনি করবেন কী করে!

বাবা ও মায়ের প্ররিশ্রম বিফলে যেতে দেয়নি পিউ।

‘‘যখন সময় পেয়েছে হয় দিদিকে না হয় বাবাকে, কখনও মাকে বলছি মা, একটু পড়ে দেবে!— এইভাবেই তৈরি হয়েছিলাম,’’ বলছে পিউ।

তার সাফল্যে এলাকার মানুষ উল্লসিত হলেও, ফল সে সন্তুষ্ট নয়। পিউ বলেছে, ‘‘আরও ভাল ফল আশা করেছিলাম। কিন্তু আমি তো অন্যদের মতো নিজে পড়তে পারি না। হয় বাবা দিদি কখনও পাড়ার কেউ পড়ে দিলে সেটা শুনেই আমি মনে রেখেছি। শিক্ষকেরা আমাকে সাহায্য করেছেন। এক স্কুল শিক্ষক ইংরেজি দেখিয়ে দিতেন। তা ছাড়া কোনও টিউশন নিতে পারিনি। কে আমাকে আলাদা দেখিয়ে দেবে!’’

সমস্যা আরও ছিল পিউয়ের। ‘‘সমস্যা হয়েছিল পরীক্ষায় রাইটার পাওয়া নিয়ে। এ বার তো আরও বড় চ্যালেঞ্জ!’’

মা মমতাদেবী এক চোখে ক্ষীণ দেখতে পান তাঁর মধ্যে মেয়েকে পড়ে শোনাতে তিনিও চেষ্টা করেছেন। বলেছেন, ‘‘আমি এক চোখে জন্ম থেকেই দেখি না। একটা চোখে সামান্য দেখতাম। চিকিৎসক বারণ করায় নবম শ্রেণিতেই ইতি টানতে হয়। আস্তে আস্তে সেই দৃষ্টিও যেতে বসেছে। ভয় ছিল, তাই বছর তিনেক বয়সে যখন দেখলাম পিউ-র চেখে সাদা স্পট, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে গিয়ে অস্ত্রোপচার করিয়েছিলাম। চিকিৎসকেরা কী করলেন ওঁরাই জানেন!’’

সেই থেকে পিউয়ের দৃষ্টি চলে গেল। এখন তাঁর ভয়, ‘‘কী ভাবে চলবে দুই মেয়ে উচ্চমাধ্যমিকের পড়ার খরচ, বুঝতে পারছি না।’’

ভালো ফল করেও চিন্তায় কৃতী ছাত্রীও। তাঁর ইচ্ছা শিক্ষকতা করার। বিজ্ঞান বা ভূগোল বিষয় উচ্চমাধ্যমিকে রাখার খুব ইচ্ছে ছিল, কিন্তু খরচের জন্যই সরে এসেছে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক কিশোরকুমার নায়েক বলেন, ‘‘এত সমস্যা, এত দারিদ্র, প্রতি পদে লড়াই সত্বেও মেয়েটি যা রেজাল্ট করেছে, তা অন্যদের কাছে দৃষ্টান্ত। চেষ্টা করব ও যেন উচ্চমাধ্যমিকেও সঠিকভাবে পড়াশোনা চালাতে পারে।’’

সামনে চিন্তা

জন্ম থেকে চোখের সমস্যায় বাড়িতে অক্ষম বাবা। ছিটেবেড়ার বাড়ির দাওয়াতে বসে ছেলেদুটোকে মানুষ করার জন্য মা দিলারা বিবি তাই প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত টিউশন পড়ান। ৩০০০ টাকা আয় হয়। মায়ের সেই টাকাতেই ছেলে রিজওয়ানুজ্জামান মোল্লার পড়া চলছে। এ বার আলামিন মিশনের অধীনে থেকে দুবরাজপুর থানার কুখুটিয়া হাইস্কুল থেকে সে ৬৬৪ নম্বর পেয়েছে। তার প্রাপ্ত নম্বর বাংলায় ৯০, ইংরেজিতে ৯০, জীবনবিজ্ঞানে ৯৯, অঙ্কে ৯৮, ভৌতবিজ্ঞানে ১০০, ইতিহাসে ৯৬ এবং ভূগোলে ৯৩।

নলহাটি থানার বারসোর গ্রামে বুধবার অবশ্য দিনভর সেই নিয়েই আলোচনা হয়েছে। দিলারা বিবি ছেলে দুটোকে কি কষ্টের সঙ্গে বড় করেছেন এবং পড়িয়ে চলেছেন, সে নিয়ে পাড়ার মোড়ে মোড়ে আলোচনা।

দিলারা বিবি বলেন, ‘‘এক বিঘে জমি আছে। বৃষ্টি হলে চাষ হয়। না হলে জমি পতিত থাকে। বাড়িতে অক্ষম স্বামী। দুই ছেলের পড়ার খরচ জোগানোর জন্য এত দিন টিউশন পড়িয়ে ৩০০০ টাকা আয় থেকে খরচ করেছি। কিন্তু বড় ছেলে উচ্চ শিক্ষা লাভ করতে চায়। সেখানে আরও বেশি খরচ! জানি না সে খরচ কি করে জুটবে!’’

ছোট ছেলে নবম শ্রেণিতে আলামিন অ্যাকাডেমিতে বাঁকুড়াতে পড়াশুনা করে। এই পরিস্থিতিতে দিলারা বিবি বলছেন, কেউ যদি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। ছেলে উচ্চ শিক্ষা লাভ করতে পারবে। তা না হলে হবে না।

কী বলছেন রিজওয়ানুজ্জামান?

অন্যদিকে ভবিষ্যতে ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছে বুকে নিয়ে তার উত্তর, ‘‘পড়ার খরচ জুটবে কি করে!’’

মায়ের স্বপ্ন

ছেলে তখন অষ্টম শ্রেণি পাশ করেছে। মেয়ে একাদশ শ্রেণিতে পড়ছে। হঠাৎ-ই এক দিন এক পথ দুর্ঘটনা ছিনিয়ে নিয়েছিল তাঁর স্বামীর জীবন। অথচ, পেশায় পুরোহিত স্বামীর সামান্য আয়েই সংসারটা চলত। বীরভূমের ময়ূরেশ্বরের তুড়িগ্রামের বাসিন্দা দীপ্তি চট্টোপাধ্যায়ের আঁধারে ঢেকে যাওয়া সেই সংসারেই ফিরে এসেছে আশার আলো।

স্থানীয় হরিপদ হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিকে ৬২৯ নম্বর পেয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছে ছেলে প্রেমানন্দ। জয়েন্ট পরীক্ষায় বসার ইচ্ছে তার। ইচ্ছে ডাক্তারি পড়ার। “কিন্তু সংসারের যা অবস্থা তাতে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে বিজ্ঞান নিয়ে যে পড়াশুনার করার ইচ্ছে সেটার খরচ কে জোগাবে!’’ রেজাল্ট হাতে নিয়ে অসহায় প্রেমানন্দ।

দীপ্তিদেবী বলছিলেন, ‘‘ওই ভাবে যে জীবনে অঘটন ঘটে যাবে ভাবতে পারিনি!’’ স্বামী কৃষ্ণানন্দ চট্টোপাধ্যায় গ্রামেই পুরোহিত গিরি করে সংসার চালাতেন। ছেলেমেয়ের পড়াশোনাও চলত ওই আয়ে। কিন্তু দু’বছর আগে মহম্মদবাজার থানার গণপুরে বাস দুর্ঘটনায় মারা যান কৃষ্ণানন্দবাবু। এর পর থেকেই জীবনে অন্ধকার নেমে আসে দীপ্তিদেবীর। মেয়ের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু ছেলের পড়াশোনা বন্ধ রাখেননি তিনি। আত্মীয় স্বজনদের সাহায্যে ছেলের পড়াশোনাচালিয়ে যাতে থাকেন দীপ্তিদেবী। ছেলে প্রেমানন্দও মায়ের ইচ্ছাপূরণে যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকল। গ্রামের অঙ্কের প্রাইভেট টিউটর ও গ্রাম ছাড়িয়ে বীরচন্দ্রপুর গ্রামের ইংরেজি প্রাইভেট টিউটর দুজনেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন। বিনা পয়সায় প্রেমানন্দকে তাঁরা পড়াশোনা করাতেন।

প্রেমানন্দ এখন তাই কেবলমাত্র পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য সরকারি অনুদান কিভাবে পাওয়া যায় তাই খুঁজে বেড়াচ্ছে। বলছে, ‘‘রামপুরহাটে ভাল স্কুলে ভর্তি হতে হবে। বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে অনেক খরচ। সে নিয়েই চিন্তা হচ্ছে। জানি না কোথা থেকে আসবে সে খরচ!’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement