বাঁ দিকে নিবেদিতা মুখোপাধ্যায়, ডান দিকে দিদি অন্তরা মুখোপাধ্যায় ও তাঁর মা। নিজস্ব চিত্র
বোনকে আমরা আদর করে ফুচুন বলে ডাকতাম। গত সোমবার কিমারির পাহাড়ি খাদ থেকে যখন ওর আধপোড়া দেহের অংশগুলো তুলে আনা হচ্ছিল, তখন ইচ্ছে করছিল ওই ছেলেটাকেও খাদে ঠেলে ফেলে দিই। কাঁদতে কাঁদতে মনে হচ্ছিল, কী অপরাধ করেছিল ফুচুন! ভালই তো বেসেছিল! এ ভাবে ওকে মেরে ফেলতে হল! এক বার সবাইকে ধাক্কা মেরে ছুটে যাই ছেলেটার কাছে। পুলিশ আটকে দেয়। ওকে গাড়িতে তুলে ফেলে ওরা। খুব গালাগালি করেছি। কিন্তু বোনটা তো আর ফিরে আসবে না। একটা সময় কাঁদতে কাঁদতে চুপ করে যাই। বোনের আধপোড়া শরীর ও ভাবে উদ্ধার হতে দেখে আমার শরীর তত ক্ষণে অবসন্ন হয়ে গিয়েছে।
ফুচুন আমার থেকে ঠিক ২ বছরের ছোট। অন্ডালে আমি ক্লাস সিক্স পর্যন্ত পড়েছি। বোন তখন ফোর। তার পর আমি মামারবাড়ি চলে এসেছিলাম মেজিয়া। ও মা-বাবার সঙ্গে থাকত। দেখা হত নিয়মিতই। কত খুনসুটি। ঝগড়াও হত মাঝে মাঝে। সেই দিনগুলো মনে পড়ছিল, যখন অঙ্কিত নামের ওই ছেলেটা বলছিল, ঝগড়া করেছিল বলে ও বোনকে ছাদ থেকে ঠেলে ফেলে দেয়। তার পর ছেলেটার এক বন্ধু আর তার বাবা তাদের গাড়িতে বোনকে নিয়ে যায় জঙ্গলে। পুড়িয়ে দিয়ে খাদে ফেলে দেয়। বিশ্বাস করতে পারছি না, ফুচুনের সঙ্গে ওরা এমনটা করেছে! ভালবেসে এ ভাবে মরতে হল আমার আদরের বোনটাকে।
গত বছরই অনুবাদ আর দোভাষীর কাজ নিয়ে ফুচুন দেহরাদূন গিয়েছিল। সেখানেই অঙ্কিতের সঙ্গে পরিচয়। তার পর প্রেম। এই সম্পর্কের কথা আমরা সকলেই জানতাম। কোথাও কোনও আপত্তিই ছিল না। তখন না ফুচুন, না আমরা, কেউই জানতাম না ওই ভালবাসা ওকে মেরে ফেলবে।
মায়ের সঙ্গে বোনের শেষ বার কথা হয়েছিল ২৮ এপ্রিল। তখন ওর সঙ্গে কথা বলে কিছুই বুঝতেই পারেনি মা। এর পর ছেলেটা বোনের ফোন থেকে ফোন করে মাকে বলে, ‘‘আপনার মেয়ে আমার সঙ্গে ঝগড়া করে বাড়ি থেকে চলে গিয়েছে। ফোনটা বাড়িতে রেখে গিয়েছে।’’ মা বার বার জিজ্ঞাসা করত, ‘আমার মেয়ে কোথায়’? ও বলত, ‘‘আপনার মেয়েকে খোঁজা হচ্ছে।’’ এ ভাবে পুরো মে মাসটা কেটে যায়। তার পর এক দিন ছেলেটি নিজের ফোনটাও সুইচড অফ করে দেয়। অথচ ও আমার বোনের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করত। আমরা কেউ বোনকে মেসেঞ্জারে মেসেজ করলে ও দেখত। ৮ জুন অবধি ছেলেটি বোনকে মেসেঞ্জারে পাঠানো সব মেসেজ দেখেছে। ছেলেটা নিজেও ফেসবুকে সক্রিয় থাকত। বোনের খবর নিতে ওকে আমরা বার বার মেসেজ করতাম। ওকে ফোন করতে বা উত্তর দিতে বলতাম। কিন্তু ছেলেটি সে মেসেজ পড়েও কোনও উত্তর দিত না।
শেষ পর্যন্ত ১৫ জুন বার বার মেসেজ করার পর ছেলেটি উত্তর দেয়। ও বলে, ‘‘কারও ফোন নম্বর দাও, ফোন করব।’’ গত ১৬ জুন অঙ্কিত আমার মাসির মেয়েকে ফোন করে বলে, ‘‘তোমার দিদি আর এই পৃথিবীতে নেই। ও ছাদ থেকে পড়ে মারা গিয়েছে।’’ এটা শুনে আকাশ থেকে পড়ে আমার মাসির মেয়ে। ও অঙ্কিতকে জিজ্ঞাসা করে, ‘‘তুমি কি পুলিশে রিপোর্ট করেছ? পোস্টমর্টেম করেছ? ছবি তুলেছ? তুমি কি ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছো?’’ প্রতিটা ক্ষেত্রেই অঙ্কিত উত্তর দেয়, ‘‘না।’’ বলে, ‘‘ও পড়ে গিয়েছিল। আমি নাড়ি দেখেছি। তার পর আমি একাই দেহ পুড়িয়ে দিয়েছি শ্মশানে।’’
এ সব শোনার পর আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। আমরা অণ্ডাল থানার সঙ্গে যোগাযোগ করি। সেখান থেকে অনুমতিপত্র জোগাড় করে ২১ মে গাড়ি করে রওনা দিই। ২৩ তারিখ দেহরাদূন পৌঁছই। ওখানকার পুলিশ আমাদের খুব সাহায্য করেছে। অঙ্কিতকে উত্তরপ্রদেশের সহারনপুর থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশের কাছে অঙ্কিত স্বীকার করেছে, ২৮ এপ্রিল রাতে ও বোনকে খুন করে। তার পর ফুচুনের দেহ মসূরীর কিমারি পাহাড়ের জঙ্গলে পেট্রল ঢেলে জ্বালিয়ে দিয়েছে। ও পুলিশকে বলেছে, ২ লিটার পেট্রল ঢেলে বোনের দেহটা জ্বালিয়ে দিয়ে বাড়ি চলে যায়। ২৬ তারিখ ওর দেখিয়ে দেওয়া জায়গা থেকেই ফুচুনের ওই আধপোড়া দেহ উদ্ধার হয়েছে। ওর ওই বন্ধুকেও গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
মা-বাবার দিকে তাকানো যাচ্ছে না। আমি নিজেও যে কী ভাবে দিন কাটাচ্ছি! সহ্য হচ্ছে না। বার বার মনে হচ্ছে, অঙ্কিতের ও সব বানানো গল্প। ঝগড়া টগড়া কিছুই হয়নি। বোন বোধহয় ওর গোপন কিছু জেনে গিয়েছিল। হয়তো ও পুরনো খুনি! ফুচুন জেনে যাওয়ায়, ওকেও খুন করে দিল!
জানি না! কিছুই জানি না! শুধু এটুকু জানি, বোন আর ফিরবে না। আর দিদি বলে ডাকবে না।