পাড়ায় পাড়ায় সভা করার অনুমতি মিলছে না বলে অভিযোগ। তাদের প্রচার খুব একটা নজরে পড়ছে না শহরের দেওয়ালেও। রাজ্যপাট চলে যাওয়ার পরে এ বারের বোলপুরে প্রবল চ্যালেঞ্জের মুখে বামফ্রন্ট। পরিবর্তিত এই পরিস্থিতিতে তাই ছাপানো ফ্লেক্স, সুদৃশ্য কার্ড এবং বাড়ি বাড়ি প্রচারই ভরসা বামেদের।
এমনিতেই এই শহরের পুরসভায় কয়েক যুগ ধরেই কোণঠাসা বামেরা। তখনও কেষ্ট মণ্ডল দাপুটে তৃণমূল জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল হয়ে ওঠেননি। এমনকী, রাজ্যের ক্ষমতা থেকে বামেরাও হঠেনি। তার পরেও বোলপুরে প্রায় ২৫ বছর ধরে বোর্ড গড়েছে বাম-বিরোধীরাই। বোলপুর পুরভোটে বাম দলগুলির ভরাডুবির ছবিটা বদলায়নি শেষ ভোটেও। ২০টির মধ্যে সাকুল্যে দু’টি ওয়ার্ডে জয়ী হয়েছিল তারা। তাতেও হয়নি শেষরক্ষা। তৃণমূল বোর্ড গঠন করার পরেই ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর দল ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেন। বিদায়ী বোর্ডে বামেদের দখলে ছিল শুধু ৮ নম্বর ওয়ার্ড। আসন্ন পুরভোটের আগে ১৭ নম্বরটি ভেঙে ওয়ার্ড সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০। এ বারের পুরভোটে তাই আগের সমর্থন ধরে রাখার পাশাপাশি ভোট বাড়ানোই প্রধান চ্যালেঞ্জ বামেদের কাছে। বাম নেতা-কর্মীদের দাবি, ৮ নম্বরের পাশাপাশি ১৭ এবং ২০ নম্বর ওয়ার্ড বামেরা জেতার ব্যাপারে যথেষ্টই আশাবাদী। এ ছাড়াও লাগোয়া ওয়ার্ডগুলিতেও শাসকদলকে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই দেওয়া যাবে বলে মনে করছে বাম নেতৃত্ব। তৃণমূল সেই দাবিকে অবশ্য ‘দিবাস্বপ্ন’ বলেই ব্যাখ্যা করেছে।
শুক্রবার ৮ নম্বর ওয়ার্ডে দলের প্রার্থী স্নেহময় গুড়িয়ার হয়ে ফ্লেক্স টাঙাতে টাঙাতে সিপিএমের এক নিচুতলার কর্মী বললেন, ‘‘আগা থেকে গোড়া— তৃণমূল একটি দুর্নীতিগ্রস্ত দল। সাধারণ মানুষের কাছে ওই দলের স্বরূপ আমরা তুলে ধরছি। পাশাপাশি বিগত বোর্ড শহরবাসীকে পানীয় জল-সহ প্রয়োজনীয় সব রকমের পরিষেবা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। বিভিন্ন প্রকল্প রূপায়ণের ক্ষেত্রেও গাফিলতি করেছে। পুরসভাকে তৃণমূলমুক্ত করে বোলপুর শহরের পুর পরিষেবার মান বাড়ানোই আমাদের লক্ষ্য। সে কথাই আমরা সাধ্যমতো আমাদের প্রচারে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।’’ প্রচারের ক্ষেত্রে শাসকদলের চোখ রাঙানির পাশাপাশি এলাকায় সভা-সমিতি করার অনুমতি দিতে পুলিশ-প্রশাসন গড়িমসি করছে বলে বাম নেতারা অভিযোগ করছেন। সিপিএমের বোলপুর জোনাল সম্পাদক উৎপল রুদ্রের দাবি, “ভোটের প্রচার এবং সভা-সমিতির জন্য পুলিশ-প্রশাসনিক অনুমতি লাগে। কিন্তু, সেই অনুমতি মিলতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। নানা অজুহাত দেখিয়ে বোলপুরের একাধিক ওয়ার্ডে সভা-সমিতির জন্য পুলিশ প্রয়োজনীয় ছাড়পত্র দেয়নি। থানা কখনও বলছে অনুমতির বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। সেই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আবার বলছেন, আবেদনপত্র পুরভোটের নির্বাচন আধিকারিকের কাছে রয়েছে। এ রকমই টালবাহানা চলছেই।’’ এখনও পর্যন্ত এ নিয়ে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের কাছে দরবার না করলেও আর কিছু দিন দেখেই এ ব্যাপারে লিখিত অভিযোগ করা হবে বলে বাম দলগুলি জানিয়েছে।
পরিস্থিতির মোকাবিলায় বেশ কিছু পন্থা নিয়েছে বামফ্রন্ট। দলীয় সূত্রের খবর, পুরনো মুখদের অনেককেই সরিয়ে প্রার্থীতালিকায় আগেই চমক দিয়েছে দল। তাঁদের অনেকেই যেমন বয়সে নবীন, তেমনই শিক্ষাগত যোগ্যতার দিক থেকেও এগিয়ে। যদিও অন্য দলগুলির তুলনায় প্রার্থীদের হয়ে প্রচারে বেশি দেওয়াল দখল করতে পারেনি বামফ্রন্ট। তাই বামেরা এ বার বেশি জোর দিচ্ছে ফ্লেক্স-প্রচারে। তার বেশির ভাগেই ‘দুর্নীতিমুক্ত পুরসভা’ গড়ার ডাক দেওয়া হয়েছে। রয়েছে প্রচার নিয়ে বামেদের বিশষ ভিত্তিক সুদৃশ্য কার্ডের প্রচার। তাতে নববর্ষের শুভেচ্ছার পাশাপাশি দেওয়া থাকছে আইপিএল-এর সময়সূচিও। অন্য দিকে, যে ক’টি দেওয়ালে বামেদের প্রচার দেখা যাচ্ছে তা-ও এ রকমই নানা স্লোগানে ভরে দিয়েছেন বাম কর্মী-সমর্থকেরা। একটি দেওয়ালেই যেমন দেখা যাচ্ছে, লেখা হয়েছে— ‘নির্বাচনের সময় ভোজ, পিকনিক দেওয়া এবং সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদের মানুষদের পণ্য ভাবা কোন রাজনৈতিক সংস্কৃতি? তৃণমূলীরা জবাব দাও?’ ওয়ার্ড ভিত্তিক, দলীয় স্তরে এবং বামফ্রন্টের সাংগঠনিক স্তর— এই তিন রকমের পদ্ধতিতে বামেরা এ বার ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রচার সারছেন। তাতে ওয়ার্ডের প্রাথমিক স্কুল, বস্তি এলাকার উন্নয়ন, নানা প্রকল্পের সুষম বণ্টন থেকে বিভিন্ন পুরপরিষেবার বেহাল দশার কথা দুয়ারে দুয়ারে তুলে ধরছেন নেতা-কর্মীরা বলে বামেদের দাবি।
বামেদের এই পরিবর্তিত কৌশলই শাসকদলের একাংশকে উদ্বেগে ফেলেছে বলে বাম নেতাদের দাবি। আর তার জেরেই শহরের বেশ কিছু এলাকা থেকে দলের ফ্লেক্স খুলে দেওয়া হয়েছে বলে বামেদের অভিযোগ। সম্প্রতি এমনটাই হয়েছে ১১ নম্বর ওয়ার্ডে। অভিযোগ, সেখানকার সিপিএম প্রার্থী উদয়নারায়ণ ভকতের প্রচারের একাধিক ফ্লেক্স বিবেকানন্দ পট্টি, সাহানি পট্টি থেকে কে বা কারা রাতের অন্ধকারে খুলে নিয়েছে। উৎপলবাবুর দাবি, ‘‘ক্ষমতা হারানোর আশঙ্কায় ভুগছে শাসকদল। তাই ভয় দেখিয়ে জোর করে ক্ষমতা দখলে রাখতেই ওরা পুলিশ-প্রশাসনকে কাজে লাগানোর পাশাপাশি বাম কর্মী-সমর্থকদের শাসানো, ভয় দেখানো কিংবা দলীয় প্রার্থীদের ফ্লেক্স খুলে দেওয়ার মতো কাজ করেছে।’’
বামেদের সমস্ত অভিযোগকেই ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছে জেলা তৃণমূল নেতৃত্ব। বোলপুরে দলের ভোট-দায়িত্বে থাকা জেলা কার্যকরী সভাপতি চন্দ্রনাথ সিংহ পাল্টা বলছেন, “বাম আমলে ওরা রাজ্যটাকে পিছিয়ে কোথায় নিয়ে গিয়েছিলেন, সবার আগে সেই তথ্যটা বামফ্রন্ট জনসমক্ষে তুলে ধরুক। পায়ের তলা মাটি খুঁজে না পেয়েই ওদের নেতারা ভুল বকছেন। তাই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে তৃণমূলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অপপ্রচার চালাতে হচ্ছে!” অন্য দিকে, বোলপুরের এসডিও তথা রিটার্নিং অফিসার মলয় হালদার এবং এসডিপিও (বোলপুর) অম্লানকুসুম ঘোষ পুলিশ-প্রশাসনের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ সম্পর্কে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি।