অভিনব: এমন বোতলেই ধরা হয় চিংড়ি। ছবি: কল্যাণ আচার্য
করোনাভাইরাসের সংক্রমণের আতঙ্ক কেড়ে নিয়েছিল রুটিরুজি। বাঁচার তাগিদেই বিকল্প পেশার খোঁজ শুরু করেছিলেন লকডাউনের মধ্যে। কেউ কাজ দেয়নি, সাহায্যও মেলেনি সেভাবে। কিন্তু ময়ূরেশ্বরের ঢেকা গ্রামের কয়েকজন যুবক নিজেরাই বুদ্ধি খাটিয়ে জীবিকা বদলে কম পরিশ্রমে বাড়তি আয়ের সন্ধান পেয়েছেন।
ওঁদের কেউ রাজমিস্ত্রী, কেউ রেজা, কেউ বা শুধুই দিনমজুর। দিনান্তে কারও রোজগার ছিল ৪০০ টাকা তো কারও ২৫০ টাকা। আর বুদ্ধি খাটিয়ে বোতল জাল বানিয়ে, তা দিয়ে চিংড়ি মাছ ধরে বিক্রি করছেন তাঁরা। এখন গড় রোজগার এসে দাঁড়িয়েছে ৪৫০-৫০০ টাকায়।
লকডাউনের জেরে অত্যাবশ্যকীয় কিছু পরিষেবা বাদে সমস্ত রকম কাজে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। বাদ যায়নি নির্মাণ শিল্পও। পরবর্তীকালে অবশ্য নির্মাণ শিল্পের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা শিথিল হয়। কিন্তু ইমারতি সামগ্রীর জোগানের অভাবে নির্মাণ কাজ শুরু হয়নি বললেই চলে। এর ফলে নির্মাণ শিল্পের সঙ্গে জড়িত রাজমিস্ত্রী এবং রেজারা জীবিকা হারিয়ে বিপদে পড়েন।
ময়ূরেশ্বরের ঢেকা গ্রামের বাসিন্দা সুব্রত চৌধুরী পেশায় রাজমিস্ত্রী। চারজনের পরিবার চলে তাঁর উপার্জনেই। লকডাউনের জেরে কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দিন আনা দিন খাওয়া সংসারের হাঁড়িতে টান পড়ে। ঘরে বসে থাকতে থাকতেই বোতল জালের ভাবনাটা আসে। বানিয়েও ফেলেন পরীক্ষামূলকভাবে। হাতেনাতে ফলও মেলে।
কেমন সেই বোতল জাল? সুব্রতবাবুরা জানাচ্ছেন, জাল হিসেবে বেছে নেওয়া হয় পানীয় জল বা ঠান্ডা পানীয়ের প্লাস্টিকের বোতল। বোতলের গলার দিকটা বিশেষ কায়দায় কেটে নেওয়া হয়। এমন ভাবে কাটা হয় যাতে মুখের দিকটা ঘুরিয়ে ঢুকিয়ে দিলে শক্তভাবে এঁটে থাকে। বোতলটি যাতে জলে ডুবে থাকে তার জন্য গায়ে বেশ কিছু ছিদ্র করে দিতে বোতলগুলি যাতে দূরে চলে না যায় তাই দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। টোপ হিসেবে ব্যবহার করা হয় ঘি মাখানো আটার চার। ছোট অংশটি খুলে টোপ ভরে আটকে দিয়ে সন্ধ্যেবেলায় পুকুর বা গড়ের জলে ভাসিয়ে দিয়ে ভোরবেলায় তুলে নিলেই হল। সারারাত ধরে চিংড়ি টোপের গন্ধে বোতলের সরু মুখ দিয়ে ঢুকতে থাকে। তারপরে আর বেরোতে পারে না।
এই বোতল জাল এখন সুব্রতদের দু’বেলা খাবার জোগাচ্ছে। তাঁর দাবি, ‘‘এই জিনিসটি তৈরি করেছি অনেক মাথা খাটিয়ে। আমার এখন ১০০টি বোতল জাল আছে।’’ তিনি জানান, পুরনো বোতল কিনতে খরচ হয় ২ টাকা করে। প্রতিদিন ১০০টি জালে টোপ হিসেবে ২০০ গ্রাম আটা আর সামান্য ঘি লাগে। তাতে খরচ পড়ে প্রায় ২০ টাকা। দৈনিক গড়ে ১ কেজি করে মাছ মেলে। কেজি প্রতি দাম পান ৪৫০-৫০০ টাকা। সুব্রত বলেন, ‘‘কাজ হারিয়ে খুব অনটনে পড়েছিলাম। তবে রাজমিস্ত্রীর কাজ করে দৈনিক মজুরি পেতাম ৪০০ টাকা। এখন অনায়াসেই সেই টাকা উঠে আসছে। ওইভাবে চিংড়ি ধরলে পুকুরের মালিকরাও কিছু বলেন না। মাঝেমধ্যে তাঁদের খাওয়ার মতো কিছুটা চিংড়ি দিয়ে দিই।’’
বোতল জালে ভাতের জোগাড় করছেন ওই গ্রামের ষষ্ঠী বাগদিও। ২৫০ টাকা রোজে রাজমিস্ত্রীর জোগাড়ের কাজ করতেন তিনি। খুশি নতুন জীবিকায়। তাঁরও ১০০টি জাল রয়েছে। শুধু সুব্রত বা ষষ্ঠীই নন, ওই গ্রামের মহাদেব বাগদি, লোকপাড়ার হাওয়া মুদি, রামকৃষ্ণপুরের সনাতন দাসরাও বোতল জালের দৌলতে অন্নসংস্থান করছেন। তাঁরা জানান, দিনমজুরি করে সংসার চলছিল টেনেটুনে। আর লকডাউনের পরে চিংড়ি ধরে ঘরে ভাত মাছও হচ্ছে আর দৈনিক রোজগারও বেড়েছে।
সুব্রতর স্ত্রী রীতা এবং ষষ্ঠীর স্ত্রী চুমকিরাও বলেন, ‘‘লকডাউনে ছেলেমেয়ের পাতে ভাত দেব কিভাবে ভেবে পাচ্ছিলাম না। এখন বোতল ফাঁদের দৌলতে প্রতিদিনই চিংড়ি মাছের বিভিন্ন পদ তুলে দিতে পারছি।’’