প্রতীকী ছবি
জমিতে পড়ে শুকোচ্ছে ফসল। কিন্তু বিক্রি করতে যাওয়ার জন্য গাড়ি মিলছে না। রেশনে চাল, আটা মিললেও তা পর্যাপ্ত নয়। একটি উপদেষ্টা সংস্থার সঙ্গে ভিডিয়ো কনফারেন্সে লকডাউন পরিস্থিতিতে এমনই নানা সমস্যার কথা তুলে ধরেছেন পুরুলিয়ার শবরেরা।
পুরুলিয়া জেলার পাঁচটি ব্লকে ১৬২টি গ্রামে বারো হাজারের বেশি শবরের বাস। তাঁদের উন্নয়নে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা ‘পশ্চিমবঙ্গ শবর খেড়িয়ে কল্যাণ সমিতি’-র ডিরেক্টর প্রশান্ত রক্ষিত বলেন, ‘‘ইংরেজ আমলে শবরদের দুষ্কৃতীর তকমা দেগে দেওয়া হয়েছিল। কয়েক দশকের চেষ্টায় শবরদের সেই বদনাম ঘুচেছে। তাঁদের ছেলেমেয়েরা স্কুল-কলেজে যাচ্ছে। চাষবাসও করছেন অনেকে। কিন্তু লকডাউনের জেরে খাবার না পেয়ে তাঁদের কেউ কেউ না, আবার চুরি-ছিনতাইয়ের কাজে নেমে পড়েন। এই ভয়টাই পাচ্ছি।’’
ওই সংগঠনের সম্পাদক জলধর শবরের বাড়ি মানবাজার ১ ব্লকের কুদা গ্রামে। ওই গ্রামের অনেকেই এখনও বছরে তিন বার ‘পুবে খাটতে’ (বর্ধমান, হুগলি জেলায় খেতমজুরের কাজ) যান। ওই গ্রামের ফুলমণি শবর জানান, বর্ধমান শহরের কাছে একটি গ্রামে তাঁরা চাষের কাজে যান। সেখানে ধান কাটার জন্য সপরিবারে তাঁদের বৈশাখের গোড়ায় যাওয়ার কথা। ফুলমণির চিন্তা, ‘‘বর্ধমানে কাজে গেলে দিনে ২২০ টাকা মজুরি পাওয়া যায়। মালিক সেখান থেকে ফোন করে ডাকছেন। কিন্তু যাব কী করে? গাড়িই তো চলছে না। এ দিকে এতগুলো পেটের ভাত জোগাড় করতে গিয়ে সমস্ত সঞ্চয় শেষ।’’
জলধরবাবু নিজেও পূর্ব বর্ধমান জেলায় কাজ করতে যান। তিনি বলেন, ‘‘জিনিসপত্রের যা দাম বাড়ছে, তাতে তেল-নুন কেনার সামর্থ্যও অনেকের নেই। রেশনে যা পাওয়া যাচ্ছে, তা-ও পর্যাপ্ত নয়।’’ তাঁর দাবি, ‘‘এখানে ১০০ দিনের কাজ মেলে না গ্রাম থেকে আমরা ৩০-৪০ জন বছরে কাজ করতে বাইরে যাই। সেখানেও যেতে না পেরে ফাঁপরে পড়েছি।’’
কিন্তু একশো দিনের কাজ দেওয়া হয় না কেন? কামতা-জাঙ্গিদিরি পঞ্চায়েতের প্রধান সোনামণি মাহাতোর অবশ্য দাবি, ‘‘আমাদের পঞ্চায়েতে একশো দিনের কাজ ভাল হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রার ৯০.১৪ শতাংশ কাজ হয়েছে। কিন্তু শবরেরা কাজ করেই টাকা চান। মজুরির টাকা ব্যাঙ্ক মারফত পেতে দেরি হয় বলে তাঁরা একশো দিনের কাজে অনীহা দেখাচ্ছেন।’’ পুরুলিয়ার জেলাশাসক রাহুল মজুমদার বলেন, ‘‘জেলায় একশো দিনের কাজ আগের বছরের তুলনায় দ্বিগুণ হয়েছে। তবে অনেকেই অভ্যাসে বাইরের জেলায় কাজে যান। তাঁরা যাতে আর বাইরে না যান, প্রশাসনের পক্ষ থেকে দেখা হবে।’’
এ দিকে, চাষাবাদ করেও শবরদের অনেকে সমস্যায় পড়েছেন। কুদা গ্রামের প্রৌঢ় খড়ু শবর, বোরোর লক্ষ্মণ শবরদের দাবি, শশা, তরমুজ-সহ গ্রীষ্মকালীন আনাজ ফলিয়ে তাঁরা গাড়ির অভাবে বলরামপুরের পাইকারি বাজারে নিয়ে যেতে পারছেন না। খড়ুবাবুর দাবি, শীতকালীন আনাজ ফলিয়ে যা লাভ করেছিলেন, তা শশা ও তরমুজ চাষে খরচ করেন। কিন্তু জলের দরে শশা বিক্রি করে মোটে ১০ হাজার টাকা পেয়েছেন। তরমুজ মাঠেই পড়ে। লক্ষ্মণবাবু বলেন, ‘‘ফসল বিক্রির টাকায় সংসার চলে। ছেলেমেয়ের টিউশনের খরচ চলে। গতবার ছাগল বিক্রি করে ধার শোধ করেছি। এ বারের ধার কী ভাবে শোধ করব?’’
শবর শিশু ও প্রসূতিদের নিয়ে চিন্তায় প্রশান্তবাবু। তিনি বলছেন, ‘‘অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র থেকে পড়ুয়াদের যে চাল, আলু দেওয়া হয়েছিল, তা অনেক পরিবারে এক দিনেই শেষ হয়ে গিয়েছে। অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র থেকে ডিম ও ছাতু দেওয়া হত। এখন সেটাও বন্ধ। তাতে শবর শিশু ও গর্ভবতীদের অপুষ্টিতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’’ তাঁর আরও আশঙ্কা, এখন হাতে টাকা কম থাকায় কেউ কেউ মদ বিক্রির কাজে নতুন করে জড়িয়ে পড়তে পারেন।
তবে প্রশান্তবাবু জানিয়েছেন, একটি সংস্থার সহায়তায়, প্রশাসনের উপস্থিতিতে আগামী বুধবার থেকে মানবাজার ১ ও ২ , পুঞ্চা, বান্দোয়ান ও বরাবাজার ব্লকে তাঁরা শবরদের খাদ্য সামগ্রী বিলি করবেন। বান্দোয়ান ব্লকেও বিলি করার ব্যাপারে আলোচনা চলছে।