রামপুরহাট হাটতলার সোনাপট্টিতে চলছে গয়না তৈরির কাজ। ছবি: সব্যসাচী ইসলাম
সোনার দর লাগামছাড়া। তাতে এমনিতেই ধুঁকছে কারবার। তার মধ্যেই ‘দেশে সোনার গয়নায় হলমার্কিং’ বাধ্যতামূলক করার ঘোষণায় চিন্তা আরও বেড়েছে জেলার স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের।
মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় ক্রেতা সুরক্ষা মন্ত্রী রামবিলাস পাসোয়ান ঘোষণা করেছেন, ২০২১ সালের ১৫ জানুয়ারি থেকে দেশে সোনার গয়নায় হলমার্কিং বাধ্যতামূলক হচ্ছে। মোদ্দা কথা হল, তার পর থেকে দেশের কোথাও আর হলমার্ক ছাড়া গয়না বিক্রি করতে পারবেন না ছোট, বড়, মাঝারি স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা। এ জন্য প্রস্তুতি নিতে গয়না বিক্রেতাদের এক বছর সময় দেওয়া হয়েছে।
সেই সময় যথেষ্ট নয় দাবি করে ব্যবসায়ীদের একটা অংশ বলছেন, ‘‘এতে ব্যবসা আরও মার খাবে। সমস্যায় পড়বেন প্রান্তিক ব্যবসাদার ও গয়নার কারিগররা। সাধারণ মানুষকেও বেশি খরচ করতে হবে।’’ তা ছাড়া হলমার্ক দেওয়ার কেন্দ্র রয়েছে হাতেগোনা। তবে ভিন্ন মতও রয়েছে। একাংশ বলছেন, ‘‘অনেক পরিচ্ছন্ন হবে ব্যবসা। ব্যবসায়ীদের চোর বদনাম ঘুচবে। হলমার্ক যুক্ত গয়না কিনলে ক্রেতাদের প্রতারিত হওয়ার কোনও ঝুঁকি থাকবে না।’’
কোনও গয়নায় ব্যবহার করা সোনা কতটা খাঁটি, তার সার্টিফিকেটই হল হলমার্কিং। দেশে ২০০০ সাল থেকে এই ব্যবস্থা চালু করেছে ব্যুরো অব ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ড (বিআইএস)। তবে এত দিন তা বাধ্যতামূলক ছিল না। ক্রেতাদের স্বার্থে আগামী বছর থেকে সেই ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করেছে কেন্দ্র। এখনও পর্যন্ত যে সব বিক্রেতা হলমার্কিং করা গয়না বিক্রির জন্য বিআইএসের কাছে নাম নথিভুক্ত করাননি, আগামী এক বছরের মধ্যেই তাঁদের তা করতে হবে। কোনও বিক্রেতা নিয়ম না-মানলে শুধু জরিমানা নয়, এক বছর পর্যন্ত জেলও হতে পারে।
জেলার স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা বলছেন, ‘‘বিভিন্ন শহরে একাধিক নামী গয়না বিপণির শাখা রয়েছে। সেখানে কেবলমাত্র হলমার্ক যুক্ত গয়না বিক্রি হয়। জেলায় প্রায় এক হাজার স্বর্ণ ব্যবসায়ী আছেন। যাঁদের একটা অংশ হলমার্কযুক্ত গয়না বিক্রি করে থাকেন। কিন্তু, সেই সংখ্যাটা একটা শতাংশ মাত্র। হলমার্ক ছাড়াই গয়না বিক্রি হয়ে থাকে। ক্রেতারাও দাম কম থাকায় হলমার্ক ছাড়া গয়না কেনেন। এক বছরের মধ্যে গোটা ব্যবস্থার পরিবর্তন রীতিমতো অসুবিধারও।’’
কেন্দ্র এই নির্দেশ দেওয়ার পাশাপাশি, ক্রেতাদের সচেতনতা বাড়াতে প্রচার চালানোরও সিদ্ধান্ত নিয়েছে। হলমার্ক করা গয়না কেনার সময়ে ক্রেতাদের গয়নার উপরে চারটি ছাপ দেখে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে বিআইএস। এগুলি হল, বিআইএসের লোগো, সোনার ক্যারাটেজ, হলমার্ক কেন্দ্রের নাম বা লোগো এবং যে দোকান থেকে গয়না কেনা হচ্ছে তার নাম বা লোগো। এমনিতে আসল সোনা ২৪ ক্যারাট ওজনের, কিন্তু এতই নরম যে তা দিয়ে গয়না বানানো সম্ভব নয়। তাই সোনার সঙ্গে কিছুটা খাদ মেশালে তবেই তা থেকে গয়না বানানো যায়। গয়না প্রস্তুতির জন্যে ২২ ক্যারাটের সোনা ব্যবহার করা হয়। যার মধ্যে সোনার পরিমাণ ৯১.৬৬ শতাংশ। সব ক্যারাটের হলমার্ক পৃথক। সোনার গয়নার ক্ষেত্রে, অর্থাৎ ২২ ক্যারাটের হলমার্ক ৯১৬। হলমার্ক দেখে কিনলে ঠকার ভয় আর থাকে না।
অখিল ভারতীয় স্বর্ণকার সঙ্ঘের রামপুরহাট শাখার সম্পাদক তুষার কর্মকার এবং বঙ্গীয় স্বর্ণশিল্পী সমিতির দুবরাজপুর শাখার সম্পাদক বিপত্তারণ দত্তের কথায়, ‘‘দুটি পুর শহরে নামী স্বর্ণ বিপণির শাখা ছাড়াও তিনশোর বেশি দোকান রয়েছে গয়নার। এমনিতেই সোনার দাম অত্যন্ত বেশি। তাই খদ্দের নেই বললে চলে। তার সঙ্গে হলমার্ক যুক্ত সোনার দাম বেশি হলে অনেক প্রান্তিক ক্রেতা সেটা কিনতে পারবেন না।’’ ওই দুই ব্যবসায়ীর ব্যাখ্যা: কারিগররা এমনিতে কম মজুরিতে গয়না প্রস্তুত করতে পারলেও হলমার্ক যুক্ত গয়না প্রস্তুত করতে খরচ বেশি। তা ছাড়া জেলায় একমাত্র রামপুরহাটে হলমার্ক দেওয়ার কেন্দ্র থাকায় সেখানে গিয়ে প্রতিটি গয়নার হলমার্ক দেওয়াতে খরচ আরও বাড়বে।
সিউড়ি, বোলপুর, সাঁইথিয়ার ব্যবসায়ীদের একাংশ বলছেন, ‘‘প্রান্তিক পরিবারে মা তাঁর নিজের গয়না ভেঙে মেয়ের বিয়ের গয়না তৈরি করান। সেগুলির অধিকাংশই যেহেতু হলমার্ক যুক্ত নয়, সেই গয়না দিয়ে হলমার্ক যুক্ত গয়না গড়াতে এলেই প্রায় ২৫ শতাংশ বাদ চলে যাবে। সেই খরচ ওই পরিবারকেই বহন করতে হবে। এ ছাড়া প্রতিটি দোকানে খাতাপত্র ঠিক রাখা রিটার্ন দেওয়ার হ্যাপা ও খরচ দুটোই বাড়বে। কী ভাবে বহন করা সম্ভব সেটা।’’
যদিও ভিন্ন মত অখিল ভারতীয় স্বর্ণকার সঙ্ঘের সিউড়ির সম্পাদক তরুণকুমার সেন এবং বঙ্গীয় স্বর্ণশিল্পী সমিতির দুবরাজপুর শাখার আহ্বায়ক আশুতোষ বসাকের। তাঁরা বলছেন, ‘‘এমনিতে ক্রেতারা এখন অনেক সচেতন। ১০০ জনের মধ্যে ২৫ জন ক্রেতা চান হলমার্ক যুক্ত গয়না। সেটা এখন দিতেও হচ্ছে। ১০০ শতাংশ এই ব্যবস্থা থাকলে ক্রেতা-বিক্রেতা সকলেরই শান্তি। তবে প্রতিটি শহর এলাকায় হলমার্ক দেওয়ার কেন্দ্র হলে সুবিধা হয়। খরচও কমে।’’