মণিশঙ্কর মাহাতো।
জঙ্গলমহলের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে এসে পুরুলিয়া রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যাপীঠের এক ছাত্র এ বার মাধ্যমিকে জেলার কৃতীদের মধ্যে নজর কেড়ে নিয়েছে। মণিশঙ্কর মাহাতো নামের ওই ছাত্র মাধ্যমিকে ৬৬৯ (৯৫ শতাংশ) নম্বর পেয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। তারই কাছাকাছি নম্বর পেয়ে (৬৬১ অর্থাৎ ৯৪.৪২ শতাংশ) মেয়েদের মধ্যে বিশেষ সাফল্য পেয়েছে আদ্রার দক্ষিণ-পূর্ব রেলওয়ে গার্লস হাইস্কুলের ছাত্রী দিতিপ্রিয়া খাঁ। সামগ্রিক ভাবে জেলার পাশের হার ৭১.৫৫ শতাংশ। তা মোটেই আশাজনক নয়। রাজ্যের ১৯টি জেলার মধ্যে মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশের হারে পুরুলিয়া জেলার অবস্থান ১৬ নম্বরে।
একসময় বান্দোয়ান বলতেই মাওবাদী উপদ্রুত এলাকা বলেই লোকে মনে করতেন। কিন্তু সেই বান্দোয়ানের ঘরের ছেলের সাফল্যে খুশি এলাকাবাসীও। বান্দোয়ান মোড় থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে বড় পড়াশিয়া গ্রামে তার বাড়ি। গ্রামে পৌঁছনোর জন্য পাকা রাস্তাও নেই, বাসও যায় না। বান্দোয়ান মোড়ে বাস থেকে নেমে কয়েক কিলোমিটার হেঁটে বা সাইকেলে গ্রামে পৌঁছতে হয় তাকে। এই গ্রামেরই প্রাথমিক স্কুলে পড়াশোনার প্রাথমিক পাঠ মণিশঙ্করের। যখন সে গ্রামের স্কুলে পড়াশোনা করেছে তখন তাঁদের বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগও ছিল না।
দিতিপ্রিয়া খাঁ।
তার কথায়, ‘‘তখন আমাদের গ্রামেই বিদ্যুৎ আসনি। গ্রামের স্কুলে পাট চুকিয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পুরুলিয়া রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যাপীঠে আবাসিক ছাত্র হিসেবে ভর্তি হই।’’ ভাল ফল করায় বিদ্যাপীঠের শিক্ষকেরা, বন্ধুরা ও বাবা-মা তাকে উৎসাহ জুগিয়েছে বলে জানায় ওই মেধাবী। তার বাবা প্রবোধকুমার মাহাতো ব্যবসা করেন। চাষও রয়েছে। মণিশঙ্করের ইচ্ছে রয়েছে চিকিৎসক হবে। তার প্রাপ্ত নম্বর: বাংলায় ৯৫, ইংরেজিতে ৯৪, গণিতে ১০০, ভৌত বিজ্ঞানে ১০০, জীবনবিজ্ঞানে ৯৮, ভূগোলে ৯৮ ও ইতিহাসে ৮৪। তবে ইতিহাসে কম নম্বর পাওয়ায় তার আফশোস রয়েছে। ইতিহাসের মূল্যায়ণ নিয়ে তাঁদের মধ্যেও প্রশ্ন রয়েছে বলে জানিয়েছে, বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষক স্বামী শক্তিপ্রদানন্দও।
পুরুলিয়া চিত্তরঞ্জন গার্লস হাইস্কুলে ফল দেখার ভিড়। ছবি: সুজিত মাহাতো।
কলা বিভাগের বিষয়গুলির মূল্যায়ন নিয়ে একই রকমের সন্দেহ রয়েছে দিতিপ্রিয়ারও। ফল জানার পরে তার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া, ‘‘ফল আর একটু ভাল হবে বলে আশা করেছিলাম। কিছুটা কম হওয়ায় সামগ্রিক ভাবে নম্বর কমে গিয়েছে।’’ আদ্রার সুভাষনগরের এই মেয়ে বরাবর স্কুলের পরীক্ষায় প্রথম হয়ে এসেছে। তিনজন গৃহশিক্ষকের কাছে সব বিষয়ে টিউশন নেওয়ার পাশাপাশি দৈনিক ছয়-সাত ঘণ্টা পড়াশোনা করত সে। বাবা দ্বারিকনাথ খাঁ ও মা রাজশ্রীদেবী দু’জনেই বাংলার শিক্ষক। দিতিপ্রিয়া জানায়, সে চিকিৎসক হতে চায়।
এ দিকে দীর্ঘ দিন পরে মাধ্যমিকে জেলায় মেয়েদের মধ্যে প্রথমসারিতে একজনকে পেয়ে খুশি এই ঐতিহ্যবাহী স্কুলের শিক্ষকলরাও। একটা সময়ে জেলায় উল্লেখযোগ্য ফল করত এই স্কুলের ছাত্রীরা। সাম্প্রতিক অতীতে সেই সাফল্য মিলছিল না। স্কুলের শিক্ষক পার্থ চক্রবর্তী বলেন, ‘‘স্কুলের পরীক্ষাগুলিতে বরাবরই প্রথম হত দিতিপ্রিয়া। আমাদের যথেষ্ট আশা ছিল ওকে ঘিরে। ওর সাফল্য ফের আমাদের স্কুল জেলায় অন্যান্য সেরা স্কুলগুলির মধ্যে উঠে এল।’’
—নিজস্ব চিত্র।