বাঁকুড়ার ঘোড়া। —নিজস্ব চিত্র।
কলকাতা শহর পত্তনের কয়েক শতাব্দী আগে ৭৪৯ খ্রিস্টাব্দে বিষ্ণুপুর শহর গড়েছিলেন মল্ল রাজারা। মল্ল রাজ্যের সূত্রপাত ৬৯৫ খ্রিস্টাব্দে। প্রথম রাজা ছিলেন আদি মল্ল। রাজধানী ছিল কোতুলপুরের কাছে লাউগ্রাম। সেখান থেকে স্থানান্তরিত হয়ে বিষ্ণুপুর। ওই সময় ছিল মল্ল রাজা জয় মল্লের রাজত্ব।
ইতিহাস বলছে ব্রিটিশ আমলে ১৭৮৭ সালে বীরভূম ও বিষ্ণুপুর নিয়ে ছিল যুক্ত জেলা। তার সদরকেন্দ্র ছিল বিষ্ণুপুর। কালেকটর ছিলেন ডব্লিউ ফাই। তার অনেক পরে ১৮০৫ সালে ২৩টি পরগনা ও মহাল নিয়ে ‘জঙ্গলমহল’ জেলার সৃষ্টি। তখন দফতর স্থানান্তরিত হয় বাঁকুড়া শহরে। জজ-ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন আলেকজান্ডার ব্রুস টড।
মল্ল রাজারা ছিলেন বিষ্ণুর উপাসক। সেই থেকেই বিষ্ণুপুর নামের উৎপত্তি। তারও পরে ১৫৯১ থেকে ১৬১৬ বীর হাম্বীরের রাজত্ব কালে চৈতন্য-শিষ্য শ্রীনিবাস আচার্যের কাছে বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর রাজ্য জুড়ে শুরু হয় মন্দির নির্মাণ। শুধুমাত্র বিষ্ণুপুরেই দর্শন্য মন্দিরের সংখ্যা ২৫টির বেশি। যা থেকে মন্দির নগরীর তকমা জুটে যায় প্রাচীন এই শহরের মাথায়। বিষ্ণুপুর হয়ে ওঠে দক্ষিণবঙ্গের গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন-শহর। ভারতের স্বাধীনতার আগেই ১৮৭৩ সালে শহরের উন্নয়নে গঠিত হয় পুরসভা। যার বয়স এখন ১৪৯। রয়েছে ১৯টি ওয়ার্ড। বর্তমানে ভোটার সংখ্যা ৫৭ হাজারেরও বেশি। পুরসভা গঠনের পর থেকেই মাত্র এক বারই পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায় এসেছিল বামফ্রন্ট। বাকি সময় পুরসভা চালিয়েছে কংগ্রেস। গত দু’দফায় বোর্ড চালিয়েছে রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল। তিরিশ বছরেরও বেশি পুরপ্রধান ছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়।
ঐতিহাসিক প্রাচীন মন্দিরগুলি ছাড়াও এ শহরের সম্পদ বালুচরী, শঙ্খ, কাঁসা-পিতল, লণ্ঠন, দশাবতার তাসের মতো নিপুন হস্তশিল্পগুলি।
দর্শনীয়, রাজআমলে তৈরি লালবাঁধ, যমুনাবাঁধ, কৃষ্ণবাঁধ, শ্যামবাঁধের মতো সাতটি বিশাল জলাশয়। আলাদা করে বলতে হয় বিষ্ণুপুর ঘরানার গান। যে ঘরানার শিল্পী তালিকায় ছিলেন যদু ভট্ট, জ্ঞানন গোস্বামী, গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো স্বনামধন্য শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের শিল্পীরা। বিষ্ণুপুর থেকে সামান্য ছাড়িয়ে পাঁচমুড়া গ্রামে তৈরি হচ্ছে বিশ্ববিখ্যাত বাঁকুড়ার ঘোড়া। তার প্রধান বিক্রয়স্থল হচ্ছে বিষ্ণুপুর। ১৭৪২ সালে বর্গি আক্রমণ হয় বিষ্ণুপুরে। সেই আক্রমণ রুখে দিয়েছিল মল্ল সেনা।
কথিত আছে, বর্গি সর্দার ভাস্কর পণ্ডিতকে দলমাদল কামান দেগে হটিয়ে দিয়েছিলেন রাজবাড়ির গৃহদেবতা মদনমোহন। সেই কামান এখনও দর্শনীয়। ১৫৮৬ থেকে ১৬২১— মুঘল-আফগান লড়াইয়ে মুঘল সম্রাটের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন মল্লরাজ বীর হাম্বীর। তখন থেকেই মুঘলদের সাহায্যে কামান তৈরির পল্লি গড়ে ওঠে বিষ্ণুপুরে। নাম দেওয়া হয় কামনটোলা। কর্মকার শ্রেণির মানুষেরা আসতে থাকেন। আসেন রাজনর্তকী লালবাঈ। তানসেনের দৌহিত্র বাহাদুর খাঁ। দ্বিতীয় দিল্লির আখ্যা পেতে থাকে বিষ্ণুপুর।
৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথম দুর্গাপুজোর আয়োজন করেছিলেন বিষ্ণুপুরের রাজা জগৎ মল্ল। প্রতিমার নাম মৃন্ময়ী। রাজবাড়ি লাগোয়া মন্দিরও নির্মাণও করেন তিনি। পুজোর ১৫ দিন আগে জিতাষ্টমী থেকে পুজো শুরু হয়ে যায়। ফলে ভিন্ন রীতির এই পুজো দেখতে ভিড় জমান পর্যটকেরা। পর্যটক টানতে ছিন্নমস্তা মন্দির লাগোয়া মাঠে প্রতি শনিবার শুরু হয়েছিল এক বিশেষ হাট। হস্তশিল্পের সম্ভার নিয়ে বসতেন স্থানীয় শিল্পীরা। লালবাঁধ সংস্কার করে হয়েছে নৌবিহারের ব্যবস্থাও। শীতের সময় সেই নৌকায় বিষ্ণুপুর ঘরানার গান শোনানোর আয়োজনও ছিল। রাস্তাঘাট আগের চেয়ে অনেক মসৃণ। উচ্চশক্তি সম্পন্ন বিদ্যুৎবাতি জ্বলছে মন্দির লাগোয়া এলাকায়। তারই মধ্যে শহরবাসীর ক্ষোভ ময়লা ফেলার ডাম্পিংগ্রাউন্ড পুরসভা এখনও করতে না পারায়। লালবাঁধ সংস্কার হলেও অন্যান্য বাঁধগুলি মজে যাচ্ছে। বিরোধীরা এখন এই সব দাবি নিয়েই পুরযুদ্ধে নামতে চলেছে।