পরীক্ষার্থী: দুই বীরহোড় কন্যা রথনি শিকারি ও জানকী শিকারি। নিজস্ব চিত্র
বীরহোড়দের গ্রামে নারী শিক্ষা প্রসারের ব্যাটন হাতে তুলে নিয়েছেন দুই বোন রথনি শিকারি ও জানকী শিকারি। দু’বছর আগে মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়েছিলেন তাঁরা। বীরহোড়দের গ্রাম বাঘমুণ্ডির ভূপতিপল্লীর ওই দুই বোন এ বার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছেন।
বাঘমুণ্ডির ধসকা পণ্ডিত রঘুনাথ মুর্মু আদর্শ আবাসিক উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী রথনি এবং জানকীকে ঘিরে প্রত্যাশা বাড়ছে তাঁদের স্কুলের শিক্ষকদের। তাঁদের দাবি, দুই বোনের হাত ধরেই বীরহোড় সম্প্রদায়ের নারীদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়াবে। কলা বিভাগের ছাত্রী ওই দুই বোনের উচ্চ মাধ্যমিকের সিট পড়েছে বাঘমুণ্ডি গার্লস হাইস্কুলে। দু’টি বিষয়ের পরীক্ষা হয়েছে। পরীক্ষা ভালই হয়েছে, জানিয়েছেন তাঁরা।
ধসকা পণ্ডিত রঘুনাথ মুর্মু আদর্শ আবাসিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সৌরভ দত্ত বলেন, ‘‘ওই গ্রামের কয়েকজন ছেলে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছে। কিন্তু কোনও মেয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেনি। ওরা বীরহোড় সম্প্রদায়ের মেয়েদের কাছে প্রেরণা।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘প্রতিকূল পরিবেশ থেকে লড়াই করে উঠে এসেছে ওরা। অদম্য ইচ্ছাশক্তির জেরেই ওরা এত দূর আসতে পেরেছে।’’ রথনি এবং জানকীর কথায়, ‘‘আমরা হস্টেলে থাকি। বইপত্রও সব কিনতে পারিনি। শিক্ষকদের সহায়তা না পেলে লেখাপড়া চালাতেই পারতাম না।’’ বীরহোড়দের নিয়ে কাজের সুবাদে তাঁদের খুব কাছ থেকে দেখছেন বলরামপুর কলেজের ইতিহাসের শিক্ষক শিবশঙ্কর সিংহ। তাঁর কথায়, ‘‘এই দুই বোন এ বার উচ্চ মাধ্যমিক দিচ্ছেন। বীরহোড় সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে এটা অবশ্যই উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনা।’’
রথনি ও জানকীর বাবা ভোলানাথ শিকারি কোনওরকমে ষষ্ঠ শ্রেণি উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। মা তুরি শিকারি প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়েছিলেন। পেশায় দিনমজুর ভোলানাথ বলেন, ‘‘আমার বাবা হীরালাল শিকারি লেখাপড়া জানতেন না। বাবার মৃত্যু হয়েছিল জঙ্গলেই। আমি তখন খুবই ছোট। মা আমাকে বড় করেন। এতটাই দরিদ্র ছিলাম যে, ষষ্ঠ শ্রেণির বেশি আর এগোতে পারিনি।’’ ভোলানাথের বড় ইচ্ছে ছিল, তাঁর তিন মেয়ে পড়াশোনা করুক। বড় মেয়ে বাসন্তী অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। এখন রথনি এবং জানকীদের ঘিরে প্রত্যাশার পারদ চড়ছে তাঁর বাবা-মায়ের। পরীক্ষার দিনগুলিতে কাজ ফেলে ভোলানাথ বসে থাকেন মেয়েদের পরীক্ষাকেন্দ্রের বাইরে। ভোলানাথের কথায়, ‘‘বড় ইচ্ছে ছিল মেয়েরা লেখাপড়া করুক। ভাল লাগছে দুই মেয়ে উচ্চ মাধ্যমিক দিচ্ছে।’’
সমাজের মূল স্রোতে যুক্ত করার লক্ষ্য নিয়ে জঙ্গলের জীবন থেকে বীরহোড়দের তুলে আনা হয়েছে বাঘমুন্ডির ভূপতিপল্লিতে। এখানে তাঁদের ঘর তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। শিবশঙ্করবাবু জানান, বীরহোড়দের জীবন জঙ্গলকেন্দ্রিক। অতীতে জঙ্গল ছেড়ে তাঁরা খুব একটা বাইরে বা লোকালয়ে আসতেন না। বেশ কয়েক বছর আগে অযোধ্যা পাহাড় বা তার আশপাশ থেকে বীরহোড়দের খুঁজে এনে ভূপতিপল্লিতে বাড়ি তৈরি করে দেওয়া হয়।’’ ওই শিক্ষাবিদের দাবি, ‘‘প্রথাগত শিক্ষার সঙ্গে এখনও ওঁদের সকলকে যুক্ত করা যায়নি। তবে এখন নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধিরা স্কুলে যাচ্ছেন।’’