বার্তা: এনআরসি বিরোধী স্লোগান মেলায়। নিজস্ব চিত্র
জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) ও সিএএ সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন নিয়ে তোলপাড় গোটা দেশ। স্বস্তিতে নেই দেশের প্রাচীনতম বাসিন্দারাও। জমি সংক্রান্ত নথিপত্রের অভাবে ভিটে-মাটি হারানোর ভয় বাসা বেঁধেছে আদিবাসীদের মধ্যেও।
সেই ভয় বা আতঙ্ক ঠিক কোন পর্যায়ে তার প্রমাণ মিলল সাঁওতাল বিদ্রোহের অন্যতম যোদ্ধা বীর বাজাল সরেনের সম্মানে সিউড়ির আবদারপুরে আয়োজিত মেলায়।
মহাজন, ব্যবসায়ী ও সুদখোরদের অত্যাচার, শোষণ ও তাচ্ছিল্যের প্রতিবাদে ১৮৫৫ সালে গর্জে উঠেছিলেন আদিবাসীরা। শুরু হয়েছিল সাঁওতাল বিদ্রোহ। সেই বিদ্রোহের অন্যতম যোদ্ধা বাজাল সরেনের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে, গত বছর থেকে মেলার আয়োজন করছে আবাদারপুর আদিবাসী ক্লাব। সহায়তায় রয়েছে আদিবাসী সংগঠন গাঁওতা। এবারও বুধ ও বৃহস্পতি এই দুদিন ধরে বিশাল মেলা আয়োজন হয়েছে। সেখানে সাংস্কৃতিক মঞ্চের বাঁদিকে এনআরসির বিরোধিতায় একাধিক পোস্টার সেঁটে প্রতিবাদ জানানো হয়েছে।
পোস্টারে লেখা হয়েছে- আদিবাসীদের হয় যদি এনআরসি বাজাল বাবা হবে আমাদের রোল মডেল বা যদি দেখ অনুপ্রবেশকারী আদিবাসীরাই কিন্তু প্রকৃত দেশবাসী। এনআরসি যদি করে ক্যে ক্যে, তির ধনুক হবে স্যেঁ –স্যেঁ।
আয়োজকদের কথায়, ‘‘এনআরসি, সিএএ আমরা মানি না। আধিকাংশ আদিবাসীর জমি সংক্রান্ত কোনও নথিই নেই। জল-জমি-জঙ্গলের অধিকার আইনের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে মামলা ঝুলছে। এই প্রতিকূলতা কাটিয়ে দেশের সবচেয়ে প্রাচীন জনগোষ্ঠী হয়েও কী ভাবে নিজেদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করবেন আদিবাসী মানুষ। এই নিয়ে চরম উৎকণ্ঠা রয়েছে। তাই বীর যোদ্ধার স্মরণে আয়োজিত অনুষ্ঠান ও মেলা প্রাঙ্গণ থেকে এনআরসি বিরোধী বার্তা দিতে চেয়েছি আমরা।’’
আয়োজকরা জানিয়েছেন সাঁওতাল বিদ্রোহের নেতৃত্বে থাকা সিধো, কানহো, এবং বীরসা মুণ্ডার নাম সকলেরই জানা। কিন্তু এমন অনেকেই ছিলেন যাঁদের ত্যাগ বীরত্ব সম্পর্কে অনেকেই জানেন না। তেমনই একজন যোদ্ধা হলেন ঝাড়খণ্ডের গোড্ডার বড় কালাজোড় গ্রামের বাসিন্দা বাজাল সরেন। রূপসিংহ তাম্বুলি নামে এক মহাজনকে খুন করার দায়ে ব্রিটিশ সরকার বাজালকে গ্রেফতার করেছিল। তাঁকে সিউড়ি সংশোধনাগারে বন্দি করা হয়। তারপর তাঁর আর কোনও হদিশ পাওয়া যায়নি। প্রামাণ্য নথি নেই। আদিবাসীদের বংশপরম্পরায় যে ইতিহাস পাওয়া যায় , তা হল বাজাল সরেন সিধো কানহু-র সহযোদ্ধা ছিলেন। তাঁর পরিবারের প্রতি শোষণ ও তাঁর স্ত্রীর উপর অত্যাচারের শাস্তি দিতেই ওই মহাজনকে হত্যা করেন তিনি। বাজাল সরেন একজন প্রকৃত শিল্পী ছিলেন। যিনি খুব ভাল বাঁশি বাজাতেন। ব্রিটিশ পুলিশ গানের আসর বসিয়ে ফাঁদ পেতে তাঁকে ধরে।
সম্প্রদায়ের গৌরবময় ইতিহাস ও সেই যোদ্ধা নিয়ে আরও বেশি করে জানা এবং নতুন প্রজন্মকে জানানোর প্রয়োজনীয়তা নিয়েই এই মেলার শুরু হয়। বুধবার দিনভর বাজাল নিয়ে হল সেমিনার। আবদারপুর আদিবাসী ক্লাবের সম্পাদক চন্দ্রমোহন মুর্মু, স্থানীয় বাসিন্দা ও সাংস্কৃতিক কর্মী লক্ষ্ণণচন্দ্র হাঁসদারা বলেন, ‘‘রাজ্য এবং রাজ্যের বাইরে এমনকি ভিন দেশ থেকেও মানুষ এসেছেন এখানে। যেমন লন্ডন থেকে এসেছেন ধুনিরাম মুর্মু। এনআরসি বিরোধী সচেতনতা গড়তে এর থেকে ভাল মঞ্চ কোথায় পাব।’’ অন্যদিকে গাঁওতা নেতা তথা মেলার পৃষ্ঠপোষক রবীন সরেন বলছেন, ‘‘আদিবাসীরা সত্যিই আতঙ্কে রয়েছে। মুখে বলছি আদিবাসী কিন্তু নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য প্রয়োজনীয় নথি কই।’’
পূর্বপুরুষ ও বীর যোদ্ধাকে জানতে বুধবার সেমিনানের জন্য বাংলাদেশ থেকে এসেছেন ছয় সদস্যের প্রতিনিধি দল। নেতৃত্বে রয়েছে বাংলাদেশের জাতীয় পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন। এসেছেন পুরুলিয়ার বান্দোয়ান থেকে ৪০ বছর ধরে প্রকাশিত আদিবাসী পত্রিকা ‘সিলি’-র সম্পাদক কলেন্দ্রনাথ মারডি, ‘তেতরে’ পত্রিকার সম্পাদক মহাদেব হাঁসদা, লেখক সারদা প্রসাদ কিস্কু প্রমূখ। বাংলা দেশের প্রতিনিধিরা এনআরসি প্রসঙ্গে কিছু না বললেও বাকিদের প্রশ্ন, ‘‘দেশের সবচেয়ে প্রাচীন বাসিন্দাদের কেন নতুন করে নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে হবে? এমনিতে আদিবাসী বনাম উন্নয়ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোথাও শিল্পের নামে কোথাও জলাশয় গড়ার নামে কোথাও খনিজ সম্পদ উত্তোলনের নামে ভিটে মাটি খোয়াতে হচ্ছে আদিবাসীদের। কেন এত সমস্যায় থাকব আমরা?’’